
বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » অপরাধ | রাজনীতি » ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই: কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের দিনভর তাণ্ডব
২০২৪ সালের ১৫ জুলাই: কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের দিনভর তাণ্ডব
পক্ষকাল ডেস্ক
আজ সেই ১৫ জুলাই। ঠিক এক বছর আগে এই দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস পরিণত হয়েছিল এক রণক্ষেত্রে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও বহিরাগতদের নারকীয় হামলায় রচিত হয়েছিল এক কলঙ্কিত অধ্যায়। পরিকল্পিত ও সহিংস হামলার মধ্য দিয়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ছবি - সংগৃহীত
শুধু ঢাবি ক্যাম্পা নয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও সরকার সমর্থক বাহির থেকে আনা সশস্ত্র ব্যক্তিরা। সহিংসতার ঘটনা পরবর্তীতে দেশের রাজনীতি, শিক্ষাঙ্গন এবং সামাজিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
পূর্বপ্রস্তুতি ও উত্তেজনার সূচনা
১৪ জুলাই বিকেলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করেন। এ বক্তব্যে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাবি ক্যাম্পাস। রাতেই ছাত্রী হলসহ বিভিন্ন হল থেকে শত শত শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসেন এবং “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার” স্লোগানে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন।
ঘোষিত কর্মসূচি ও সংঘর্ষের সূচনা
১৫ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাবির রাজু ভাস্কর্য চত্বরে জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। কিছু শিক্ষার্থী টিএসসিতে অবস্থান নেন, আরেক অংশ মিছিল নিয়ে হলপাড়ার দিকে অগ্রসর হন। বেলা ৩টার দিকে বিজয় একাত্তর হলের সামনে শিক্ষার্থীদের একটি দল ঢুকতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়ে। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ।
পরিকল্পিত হামলা ও বহিরাগতদের অংশগ্রহণ
চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিল, ছাত্রলীগের সঙ্গে ঢাকায় বিভিন্ন সরকারি কলেজ (যেমন বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ) ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি। বঙ্গবন্ধু হলের পেছনের পকেট গেট দিয়ে দেখা যায়, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের কর্মীরা ঢুকে পড়ছেন। এদের অনেকেই হেলমেট পরা ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিলেন।
ছাত্রীদের বাসে হামলা
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। হামলার মুখে পড়ে কিছু ছাত্রী ঢাবির বিআরটিসির একটি লাল বাসে আশ্রয় নেন। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের বাস থেকে নামিয়ে মারধর করে। বাসের জানালায় ইট ছুড়ে কাচ ভাঙা হয়, অনেক শিক্ষার্থী কাঁচ ও ইটের আঘাতে আহত হন। ছাত্রীদের হাত ধরে টানাটানি, শারীরিক হয়রানির ঘটনাও ঘটে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও হামলা
হামলার শিকার শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা নিতে গেলে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ২০-২৫ জনের একটি দল হাসপাতালে ঢুকে আহতদের ও তাদের সহপাঠীদের মারধর করে। আনসার সদস্যরা বাধা দিলে হামলাকারীরা কিছুক্ষণ পর বের হয়ে যায়, কিন্তু পরে আবার ফিরে আসে। এতে সাধারণ চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
শিক্ষার্থীদের পিছু হটা ও গণআন্দোলনের সূচনা
হামলার মুখে পড়ে আন্দোলনকারীরা ফুলার রোড, শহীদ মিনার ও নীলক্ষেতের দিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রক্তাক্ত ছাত্রছাত্রীর ছবি ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। দেয়ালজুড়ে স্লোগান লেখা শুরু হয়- ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘শিক্ষার্থীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবে না প্রজন্ম’।
সরকার ও ছাত্রলীগ নেতাদের প্রতিক্রিয়া
ওইদিন সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা বলেন, “নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না।”
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, “এই যুগের রাজাকারদের পরিণতি ৭১ সালের রাজাকারদের মতোই হবে।”
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “ছাত্রলীগই জবাব দেবে।”
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আন্দোলনকারীদের “শেষ দেখে ছাড়বেন” বলে হুমকি দেন। এসব বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশেই ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে।
পরবর্তী কর্মসূচি ও ছাত্র প্রতিরোধ
১৫ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় ওই সময়ের ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৬ জুলাই সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল এবং নতুন কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে হামলাকারীদের প্রবেশ ঠেকানোর সিদ্ধান্ত নেন।
দেশজুড়ে সহিংসতা
একই দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, এম এম কলেজ যশোরসহ অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে। কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হন।
১৫ জুলাই ঢাবি শুধু একটি সংঘর্ষের দিন নয়, এটি বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শিক্ষার্থীদের ওপর রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধান-ঘনিষ্ঠ ছাত্রসংগঠনের এই ধরণের সহিংসতা গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকারের ওপর বড় প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায়। এই ঘটনার পর আন্দোলন যেমন দমে যায়নি, তেমনি দেশজুড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক চেতনার বীজ বপিত হয়।