
শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » অপরাধ | রাজনীতি | সম্পাদক বলছি » “বাংলাদেশের যাত্রা কোন পথে-নির্বাচন, অরাজকতা না কি বৈপ্লবিক প্রতারণা?”
“বাংলাদেশের যাত্রা কোন পথে-নির্বাচন, অরাজকতা না কি বৈপ্লবিক প্রতারণা?”
সম্পাদকীয়: “বাংলাদেশের যাত্রা কোন পথে-নির্বাচন, অরাজকতা না কি বৈপ্লবিক প্রতারণা?”
শফিকুল ইসলাম কাজল রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিশ্লেষক | লেখক, ‘Voices of South Asia’
২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র বিপুল অস্থিরতায় আবর্তিত। জনতার দাবি থেকে জন্ম নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার, সেই সরকারের করা প্রতিশ্রুতি-বিশেষত “জুলাই ঘোষণাপত্র”-এখন সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাতে যুক্ত হয়েছে মব-সন্ত্রাস, ইসলামি উগ্র ফ্রন্টের উত্থান এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিজস্ব স্বীকারোক্তি। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠে-বাংলাদেশ আদৌ একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে পাবে, না কি এটি একটি নতুনধারার বৈপ্লবিক প্রতারণার শিকার?
জুলাই ঘোষণাপত্রের বিলম্ব: গণতন্ত্রের গলায় ফাঁস?
জুলাই অভ্যুত্থানে জনতার জয় হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় গণআন্দোলনের মুখে। সেই সরকারের প্রধান ইউনুস জনগণের সামনে ‘৩০ কর্মদিবসে’ একটি জাতীয় ঘোষণা পত্রের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু এখন প্রায় তিন মাস-ঘোষণাপত্র নেই, জনগণের অংশগ্রহণ নেই, বরং গোপন বৈঠক, বিধিবহির্ভূত কমিটি আর শর্তযুক্ত দলীয় আলোচনা চলছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP) সহ অনেক সংগঠন নিজেদের বিকল্প ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে, যা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পরিকল্পনা বিভ্রান্ত করছে।
ইসলামি দলের উত্থান: ধর্ম দিয়ে বিপ্লবের ভাষা দখল?
“ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ” থেকে “খিলাফত মজলিস”-সবাই এখন জুলাই আন্দোলনকে “ঈমানি জাগরণ” দাবি করছে। তাদের ১৬ দফার দাবিতে নির্বাচন, সংবিধান সংশোধন এবং “জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি” বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে। এসব দাবি বাস্তবতার প্রশ্ন তোলে-আসলেই কি তারা গণআন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছে, না কি তার উপর দখলদারি করছে?
সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য: রাজপথে বিচারবহির্ভূত ‘নীতি’
পুরান ঢাকায় প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড-যেখানে ব্যবসায়ী সোহাগকে ইট-পাথর দিয়ে মারা হয়-রাষ্ট্রের নীরবতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেরি, ভঙ্গুর বিচারপ্রক্রিয়া, এবং দলীয় লোকদের রাজনৈতিক দায় এড়িয়ে বহিষ্কার ঘোষণাই যেন “ন্যায়বিচার”।
এই ঘটনার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গ্রেপ্তার আরও বিপজ্জনক বার্তা দেয়-বুদ্ধিজীবীদের মতপ্রকাশের অধিকার দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে।
সাবেক আইজিপি’র রাজসাক্ষী হওয়া: রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বীকারোক্তি?
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, যিনি ছিলেন দেশের পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি, আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হয়ে প্রমাণ করছেন-ক্ষমতার ভেতরে থাকা সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানেও অপরাধ ঢুকে পড়ে।
এই স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামো নিজেই নিজের দুর্বলতা সামনে আনছে।
নির্বাচন না কি ষড়যন্ত্র?
সব মিলিয়ে একটি বাস্তব প্রশ্ন সামনে আসে-
জুলাই বিপ্লব ছিল জনগণের জাগরণ
অন্তর্বর্তী সরকার ছিল স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি
ইসলামি ফ্রন্ট এখন দাবি করছে “আল্লাহর রাষ্ট্র”
রাজপথে মব আইন চলছে
রাষ্ট্রযন্ত্র স্বীকার করছে পুরনো সরকারের অপরাধ
তাহলে এই “নির্বাচনের” নামে কী হতে যাচ্ছে?
জনগণের ভোট নয়
স্বাধীন কমিশনের পরিকল্পনা নয়
ষড়যন্ত্রে আবদ্ধ গোপন চুক্তি
আদর্শিক ভাষা দখলের চেষ্টা
জনমতের বাইরে ক্ষমতা বণ্টনের খেলা
পরামর্শ ও দাবি
বাংলাদেশ যদি সত্যিই গণতন্ত্রের পথে ফিরে যেতে চায়, তাহলে:
জুলাই ঘোষণাপত্র অবিলম্বে জনতার সামনে প্রকাশ করুন
ধর্মীয় উগ্র মতবাদ দিয়ে বিপ্লবকে বিকৃত করার চেষ্টা বন্ধ করুন
সোহাগ হত্যাকাণ্ডসহ সব বিচারবহির্ভূত ঘটনার দ্রুত তদন্ত করুন
গ্রেপ্তারকৃত বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের মুক্তি দিন
নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করুন
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগে সম্মতি দিন
গুম নিয়ে বানিজ্য বন্ধ করুন,গুম কমিশ্ন বাতিল করুন
বাংলাদেশ এখন এক দ্বিধার জায়গায় দাঁড়িয়ে-যেখানে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে জনগণের সচেতনতা, স্বচ্ছতা ও সাহস। জুলাই বিপ্লব যদি আদর্শগতভাবে হরণ হয়, যদি নির্বাচন হয় গণহীন, তাহলে ইতিহাস বলবে-এটি ছিল কেবল একটি রাজনীতিক পর্দার খেলা।