
সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » অপরাধ | অর্থনীতি | বিনোদন | রাজনীতি | সম্পাদক বলছি » সম্পাদকীয় নিবন্ধ “সামাজিক ব্যবসা” রাষ্ট্রের বিকল্প নয়, গণতন্ত্রের বিকল্প নয় বরং এটি অপশাসনের নতুন মুখোশ
সম্পাদকীয় নিবন্ধ “সামাজিক ব্যবসা” রাষ্ট্রের বিকল্প নয়, গণতন্ত্রের বিকল্প নয় বরং এটি অপশাসনের নতুন মুখোশ
সম্পাদকীয় নিবন্ধ
“সামাজিক ব্যবসা” রাষ্ট্রের বিকল্প নয়, গণতন্ত্রের বিকল্প নয়
বরং এটি অপশাসনের নতুন মুখোশ
সামাজিক ব্যবসা বা সোশ্যাল বিজনেসের আদর্শ খুবই উজ্জ্বল: “লাভ নয়, প্রভাব”- দরিদ্রের পাশে দাঁড়ানো, সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলা। বিশ্বজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের সফলতা এই ধারনাকে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। কিন্তু সেই উজ্জ্বল আবরণের আড়ালে আজ দেখা যাচ্ছে এক ভিন্ন রূপ: - সরকারি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়, “সামাজিক ব্যবসা” নিজেকে রাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে অস্থির করে তুলছে। - নৈতিক দায়বোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বাইরে থেকে ব্যক্তিগত অথবা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার ঘটছে। - একভাবে এ হচ্ছে “অপশাসনের নতুন মুখোশ”- যেখানে জনগণের ক্ষমতাও বঞ্চিত, নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যাতত্ত্বও ক্ষুণ্ণ।
রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ও এনজিওর ভূমিকা
১. রাষ্ট্রের মূল কর্তব্য- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা। ২. এনজিও বা সামাজিক ব্যবসার স্বার্থ- সেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব, পুঁজির প্রবাহ ও ব্র্যান্ডিং।
যখন রাষ্ট্রের সংবিধানিক দায়িত্ব হয়ে উঠে বেসরকারি অর্থ ও স্বেচ্ছাসেবার ওপর নির্ভরশীল, তখন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা সংকুচিত হয়। - সরকারি বরাদ্দ কমে গেলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বাধ্য হয় এনজিওর হস্তক্ষেপে। - এনজিওর জন্য নির্ধারিত বিশেষ সুবিধা (কর ছাড়, ভর্তুকি, বিশেষ লাইসেন্স) রাষ্ট্রের স্বাভাবিক উন্নয়ননীতিকে অক্ষত রাখতে ব্যর্থ করে। - দুর্নীতি-উত্তোলনও নানা সরলীকৃত পথে সাজানো হয় “সদ্ভাবনার” আড়ালে।
গণতন্ত্র বনাম স্বেচ্ছাসেবী আধিপত্য
গণতন্ত্র মানে ভোটের শক্তি, স্বচ্ছ নীতি-নির্ধারণ আর জনগণের অংশগ্রহণ- যা কোনোভাবেই ব্যক্তিগত আর্থিক ছোট-বড় স্বার্থের কারসাজির বিরুদ্ধে আবদ্ধ হতে পারে না।
সামাজিক ব্যবসার একক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় জনমত, প্রতিরোধ ও সমালোচনার জায়গা সংকীর্ণ হয়।
কোনো প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ও সমন্বয়ের বাইরে থেকে নীতিমালা প্রণয়ন করলে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
গণতান্ত্রিক আস্থার ভিত্তিকল্প হলে “মনোনীত” অথবা “আন্তর্বর্তী” সরকার বলে কিছু ধারণাই তৈরি হয়, যা বাস্তবেই হুমকি বহন করে।
অপশাসনের নতুন মুখোশ: নেতিবাচক পরিণতি
১. স্বচ্ছতার অভাব: এনজিও খাতের আর্থিক প্রতিবেদন, প্রকল্প মূল্যায়ন ও বাস্তব প্রভাব প্রাথমিক পর্যায়ে লুকিয়ে রাখা হয়; ফলশ্রুতিতে দুর্নীতি ও অপব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ২. জবাবদিহিতা ভাঙন: গণতান্ত্রিক অনুজ্ঞাপ্রকল্প- যেখানে ত্রুটি থাকলে ভোটার, জাতীয় পর্যবেক্ষক বা বিচারব্যবস্থা শোধন করতে পারে- সেই পথ বন্ধ করে দেয় একটি স্বেচ্ছাসেবী শক্তি। ৩. সামাজিক ন্যায়বিচার সংকট: দরিদ্ররা রাষ্ট্রের সকল সুরক্ষা, বেতনভিক্তিক কল্যাণ ও মৌলিক অধিকার জাতীয় নীতিমালায় পায় না; তারা পড়ে “এনজিওর গোলামি” সেই শর্ত মেনে চলতে বাধ্য হয়ে।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে জন্ম দেয় দুটি সমান্তরাল সমস্যা- যুক্তরাষ্ট্রীয় দুর্নীতি এবং গণজাগরণ- উভয়ই অপ্রতিরোধ্য, যাতে সংকট আরও জটিল হয়।
সামাজিক ব্যবসাকে সম্পূরক হিসেবে স্বাগত জানাতে পারি, তবে তা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও বিধিমালার বাইরে গিয়ে আধিপত্য বিস্তার করলে গণতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি। - সরকারকে তদারকি বাড়াতে হবে: এনজিওদের নিবন্ধন, আর্থিক অডিট ও প্রকল্পের স্থানীয় সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। - জনগণের অংশগ্রহণ ও সরকারি জবাবদিহিতা শীর্ষ অগ্রাধিকার করতে হবে- এতে সামাজিক ব্যবসার প্রকৃত লক্ষ্য বজায় থাকবে। - নইলে “সামাজিক ব্যবসা” থেকে জন্ম নেবে “অপশাসন”- উজ্জ্বল মুখোশের আড়ালে একটি নতুন শাসনতন্ত্র, যেখানে ভোটের শক্তি সংকীর্ণ হয়ে ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে পরিণত হবে।
গণতন্ত্রের সুরক্ষা আর সামাজিক স্থিতিশীলতা চাইলে আজই নির্ধারণ করতে হবে: সামাজিক ব্যবসা কখনোই রাষ্ট্রের বিকল্প নয়, পক্ষান্তরে এটি হতে পারে অংশীদার-সীমাবদ্ধ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক।