
শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » রাজনীতি » মতামত: দলীয় স্বৈরতন্ত্রের লড়াইয়ে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলো
মতামত: দলীয় স্বৈরতন্ত্রের লড়াইয়ে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলো
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেখানে ভিত তৈরি করা উচিত জনমতের ওপর, ক্ষুদ্র দলগুলো আঞ্চলিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৌড়ঝাঁপে মেতে উঠেছে। তারা যে পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের উদাহরণ হতে পারত, তার পরিবর্তে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ইচ্ছার আক্রমণাত্মক বাহক হয়ে উঠেছে—মনোনয়ন গণতন্ত্র নয়, আনুগত্যের পরীক্ষা, ভোট নয়, লবিংই এখন মূল চালিকাশক্তি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে যখন সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত, তখন জামায়াত, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র দল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক লড়াই শুরু করেছে-স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। তারা দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে পিছু হটিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ গড়তে ব্যস্ত, যাতে প্রার্থী মনোনয়ন অর্থাৎ তাদের সিদ্ধান্ত থাকছে দলীয় নেতামণ্ডলীর হস্তাধিকারেই।
সমকালীন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
দলীয় সরল কাঠামো নই; ঘনিষ্ঠ স্বশাসন: ক্ষুদ্র দলগুলোতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ছাড়া অন্য কোথাও আদৌ মতামত শোনা যায় না।
নীচের স্তরের নেতাকর্মীরা পদোন্নতি আশা করেও নাম প্রকাশ করতে পারছে না-আন্তঃদলীয় প্রতিযোগিতার বদলে ব্যক্তিস্বার্থের লবিং চলে।
প্রার্থী বাছাই এখন নীতিমালার ভিত্তিতে নয়, ব্যক্তিগত আনুগত্যের পরীক্ষায় আটকা পড়েছে।
গণতন্ত্রের মূল্যায়ন
দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য অন্তরায় তৈরি করছে এই কার্যপ্রণালী। কারণ:
স্বচ্ছতা হারিয়ে থাকে-মনোনয়ন প্রক্রিয়া গোপন, ফলে দুর্নীতি ও ক্ষমতালিপ্সার জায়গা বাড়ে।
জন আস্থা ক্ষুণ্ন হয়-দল যখন জনসেবার বদলে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দেয়, তখন ভোটারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে পড়ে।
রাজনৈতিক সংস্কার বিলীন-ক্ষুদ্র দলগুলোই তো দেশের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রবর্তনে পথপ্রদর্শক হতে পারে; কিন্তু তারা নিজেই সে সুযোগ নষ্ট করছে।
প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
দলীয় সংবাদের বাইরে সাধারণ সদস্যদের ভোটাধিকার সুনিয়ন্ত্রিত করতে হবে-মনোনয়নে সর্বনিম্ন তিন স্তরের মনোনয়ন বোর্ড গঠন বাধ্যতামুলক করতে হবে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নের উপায় সহজীকরণ ও স্বচ্ছ তথ্যভাণ্ডার প্রকাশ: যে কোনো ভুক্তভোগী অনায়াসেই আপিল বা প্রতিবেদন দান করতে পারুক।
নাগরিক সমাজ ও নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থার নিয়মিত হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে-ভ্রষ্টাচার রোধে স্থানীয় পর্যায়ের গণতান্ত্রিক মূল্যায়ন জরুরী।
নির্বাচনকে জনগণের হাতে ফেরাতে চাইলে ক্ষুদ্র দলগুলোকেই আগে নিজেদের আঙ্গিনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর বিকল্প নেই-স্বৈরতন্ত্র নিয়ে যে লড়াই চলছে, তা অব্যাহত থাকলে দেশের গণতন্ত্রই বিপন্ন হবে।
আরও পদক্ষেপ যা ক্ষুদ্র দলগুলো কার্যকরীভাবে গ্রহন করতে পারে
নির্দিষ্ট মেয়াদে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন - দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সর্বোচ্চ তিন পদে একবারে দুইবারের বেশি মেয়াদে থাকা নিষিদ্ধ করা। - মেয়াদ শেষে কমিটি বিলুপ্ত, সাধারণ মনোনয়ন ও গননাসভা দিয়ে নতুন কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক।
ডিজিটাল ভোটিং ও মনোনয়ন তফসিল প্রকাশ - স্মার্টফোন-ভিত্তিক নিরাপদ ভোটিং ব্যবস্থা; মনোনীতদের তালিকা, নির্বাচনের ফি ও শর্তাবলী ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত রাখার চর্চা। - মনোনয়ন বোর্ডের সভা-ফলাফল (‘minutes’), আপিল প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্তসমূহ যেকোনো দলের সদস্য সহজে দেখতে পাবে।
অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা নিশ্চিতকারী ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ - ১০-১৫ জন সাধারণ সদস্যের সমন্বয়ে কাজের ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন; প্রশাসনিক কমিটির কাছে বার্ষিক অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দিবে। - গ্রুপে অবশ্যই নারী, যুব ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি রাখবে, যাতে ন্যূনতম অন্যায় প্রতিবেদন করার রুট থাকে।
দলীয় তহবিল-ব্যয়ের অডিট পদ্ধতি - তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের খতিয়ান প্রতি ছয় মাসে দেশের স্বীকৃত অডিট সংস্থাকে যাচাইয়ের জন্য জমা দিতে হবে। - আটকে থাকা তহবিল বা অনৈতিক উৎসের টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেকে জবাবদিহি রাখবে।
বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত: ছোট দলেও গণতন্ত্র
জার্মানি: গণমাধ্যম-সমর্থিত মনোনয়ন - ছোট দল “Freie Wähler” গণমাধ্যমের সরাসরি টিভি-ডিবেটের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করে, যাতে সদস্যরা সরাসরি প্রশ্ন করতে পারে।
জাপান: স্বচ্ছ ফান্ডিং - ছোট দলগুলোকে নির্বাচনী তহবিলের উৎস প্রকাশ বাধ্যতামূলক করেছে; অনলাইনে কোনো ব্যক্তি এক লাখ ইয়েনের বেশি অনুদান দিতে পারে না।
আর্জেন্টিনা: আদর্শগত আলোচনাসভা - “স্থায়ী আলোচনা পরিষদ” নামে ছোট দলগুলো নিয়মিত মাসিক ভার্চুয়াল মিটিং ছক করে, যেখানে সদস্যরা ইস্যু হাতেখড়ি থেকে স্পষ্ট ভাবে ফিডব্যাক দেয়।
সক্রিয় নাগরিক অংশীদারিত্ব ও মনিটরিং
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-সূত্রে তদারকি - সুসংবাদ ডট কম বা politiWatch-এর মতো অনলাইন মনিটরিং প্ল্যাটফর্মে দলীয় প্রতিশ্রুতি, মনোনয়ন ও ভোট-ফলাফল আপলোডের নিয়ম।
স্বেচ্ছাসেবী অবলম্বন - স্থানীয় পর্যায়ে যুব সংগঠন, নারীবাদী গোষ্ঠী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষক রাখার আহ্বান।
আইন সংস্কার চিত্রনাট্য - নির্বাচনী আইন ও রাজনীতিক দলের আইন-২০১১-এ “ইন্টারনাল ডেমোক্রেসি” ধারা সংযোজন; প্রতি পাঁচ বছরে ইসিতে ভোক্তা মতামত জমা দেবে সংসদ সদস্য নির্বাচন ছাড়াও দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের বিষয়ে।
অবশেষে
ক্ষুদ্র দলগুলোই হতে পারে জাতীয় রাজনীতির কর্মঘণ্টা পরিবর্তনের অবলম্বন। তারা যদি এই সূক্ষ্ম সংস্কারগুলো দলে কার্যকর করে, তবে ভুল কোনো অঙ্গীকার নয়-অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংগঠনিক অন্যায় দূরীকরণে তারা আরেক দিকনির্ঘটক হবে।
অতএব, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর বিকল্প নেই-দলীয় স্বৈরতন্ত্র জয়প্রাপ্ত হবে না। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে, প্রথমে নিজ ঘরে গণতন্ত্র ফেরান।
উল্লেখ্য, এসব সুপারিশ দ্রুত প্রয়োগে ক্ষুদ্র দলগুলোর স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়বে, যা অবশেষে গণমানুষের ভরসা ও আস্থা জোরদার করবে।