শতবর্ষকে ‘ভীতিকর’ বললেও কর্মবিরতিতে নারাজ ক্লান্তিহীন মাহাথির
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ শতবর্ষে পা রাখলেন। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) জীবনের এই ঐতিহাসিক মাইলফলক স্পর্শ করে মুহূর্তটিকে ‘বেশ ভীতিকর’ বলে অভিহিত করলেও তার কর্মচাঞ্চল্যে ভাটার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
মাহাথির মোহাম্মদ
মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে মাহাথির মোহাম্মদ এক বর্ণময় চরিত্র, যিনি তার রূপান্তরকারী এবং কখনও কখনও বিতর্কিত নেতৃত্বের জন্য পরিচিত। তিনি ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দেশটির চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী এবং পরে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই মালয়েশিয়ার ইতিহাসে দীর্ঘতম ও সবচেয়ে বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী।
শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও মাহাথির উল্লেখ করার মতো সক্রিয়। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেই তিনি তার বিশেষ সাফারি স্যুট পরে সকালেই পুত্রজায়ার দপ্তরে কাজে যোগ দেন।
জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশেষ পডকাস্টে তিনি বলেন, “যারা আমাকে কেক, ফুল, চিঠি পাঠিয়েছেন এবং আমার ১০০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। ১০০ বছর বয়স পাওয়া বেশ ভীতিকর।”
পডকাস্ট চলাকালীন মাহাথির মালয়েশিয়ার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো স্মরণ করার পাশাপাশি ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন এবং চীনের উত্থান নিয়েও কথা বলেন।
অতীতে মাহাথির তার দীর্ঘ জীবনের রহস্য হিসেবে ধূমপান ও অতিরিক্ত খাবার পরিহার এবং মস্তিষ্কের ব্যায়ামকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বার্ধক্য নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবনা ভাগ করে নেওয়ার সময় তিনি জানান, হৃদরোগের ইতিহাস এবং দুটি বাইপাস অস্ত্রোপচার সত্ত্বেও মানসিক ও শারীরিকভাবে সচল থাকাই তাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
তিনি বলেন, “আমি সবসময় সক্রিয় ছিলাম। যারা কেবল বিশ্রাম নিতে চায়, আমি তাদের বুঝতে পারি না। আপনি ছুটিতে যান, কিছু একটা করেন। কিন্তু কিছু মানুষ অবসর নিয়ে বিশ্রাম করতে চায়। এই বিশ্রামের অর্থ কী? আপনি কিছুই করবেন না?”
তিনি আরও যোগ করেন, “যতদিন আমি কর্মক্ষম থাকব, আমি কাজ করে যেতে চাই। আমি এমনভাবে আচরণ করতে চাই যেন আমি বুড়ো হচ্ছি না। আমি তরুণ বয়সের মতোই জীবনযাপনের চেষ্টা করি। আমি কাজ করি, দপ্তরে আসি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিই। আমি মনে করি, এই সক্রিয় থাকাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত না হওয়াকে নিজের সৌভাগ্য বলেও স্বীকার করেন মাহাথির। তিনি বলেন, “আমি এত দিন বেঁচে থাকার জন্য আলাদা কোনো চেষ্টা করিনি, তবে আমি আমার স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়েছি।” নিজের এই জন্মদিনকে তিনি একটি ‘সাধারণ দিন’ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখ্য, মাহাথিরের প্রথম ২২ বছরের শাসনামলে মালয়েশিয়া একটি আধুনিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হলেও, ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে তিনি কঠোর রাজনৈতিক দমন-পীড়নের আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বহু শত কোটি ডলারের দুর্নীতি কেলেঙ্কারির জেরে তিনি অবসর ভেঙে রাজনীতিতে ফিরে আসেন এবং পুরনো শত্রুদের সঙ্গে জোট গঠন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন, যা গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল।
৯২ বছর বয়সে পুনরায় ক্ষমতায় এসে তিনি একজন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা নায়ক হিসেবে সমাদৃত হন এবং ১৯৫৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মালয়েশিয়ার প্রথম বিরোধী দলীয় বিজয়ের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু সেই ভাবমূর্তি বেশিদিন টেকেনি। মাত্র ২২ মাসের মাথায় তার সরকার অন্তর্দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ে এবং বিরোধী দলে থাকাকালীন তিনি মালয় আধিপত্যের পক্ষে কথা বলে একজন বিভাজন সৃষ্টিকারী নেতায় পরিণত হন, এমনকি যে ইসলামপন্থী দলের তিনি তীব্র সমালোচক ছিলেন, তাদের সঙ্গেও কাজ করেন।
জন্মদিনের পডকাস্ট শেষে মাহাথির তার দপ্তরে আরও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে দেখা করেন। তার সহযোগী সুফি ইউসুফ জানান, যদিও কোনো বড় আয়োজন ছিল না, তবে কর্মীরা একটি ছোট কেক নিয়ে এসে জন্মদিনের গান গেয়েছেন। স্বভাবসুলভ শৃঙ্খলার সঙ্গে মাহাথির সেই মুহূর্তের ইতি টানেন এই বলে: “আচ্ছা, কাজে ফেরা যাক!”