
শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশ্ব সংবাদ | রাজনীতি » ‘ব্রিটেনকে মূল্য দিতে হতে পারে’: রুশ ক্ষোভ ও ভূরাজনৈতিক বার্তা
‘ব্রিটেনকে মূল্য দিতে হতে পারে’: রুশ ক্ষোভ ও ভূরাজনৈতিক বার্তা
প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ | ২৭ জুন ২০২৫
যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে £৭০ মিলিয়ন মূল্যের ASRAAM ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা এবং এর অর্থায়নে রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদের সুদ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। রাশিয়া এই পদক্ষেপকে “আগ্রাসী অর্থনৈতিক যুদ্ধ” হিসেবে আখ্যা দিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, এর জন্য ব্রিটেনকে মূল্য দিতে হতে পারে।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া: কূটনৈতিক হুমকি না সরাসরি পাল্টাঘাত?
ক্রেমলিন-ঘনিষ্ঠ প্রচারক ভ্লাদিমির সলোভিয়ভ রুশ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলেন, “ব্রিটিশ নাগরিক ও কোম্পানিগুলো এখন বৈধ লক্ষ্যবস্তু।” এই বক্তব্য শুধু কূটনৈতিক চাপ নয়, বরং হাইব্রিড যুদ্ধের অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক ও সাইবার হামলার ইঙ্গিত বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউরোপে থাকা নিজের প্রায় $৩০০ বিলিয়ন সম্পদ জব্দ হওয়াকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে দাবি করে আসছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, এই সম্পদ জব্দ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও যুদ্ধবিধি রক্ষার স্বার্থে।
যুক্তরাজ্যের অবস্থান: ন্যায্যতা বনাম নজিরবিহীনতা
প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, “রাশিয়ার বর্বরতা ইউক্রেনকে মূল্য দিতে বাধ্য করবে না। বরং পুতিনকেই এর দায় নিতে হবে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য নৈতিক অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে, যেখানে যুদ্ধের খরচ আক্রমণকারী রাষ্ট্রের সম্পদ থেকেই মেটানো হবে।
তবে আন্তর্জাতিক আইনবিদদের একাংশ বলছেন, জব্দকৃত সম্পদের সুদ ব্যবহার করে অস্ত্র কেনা একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
ভূরাজনৈতিক প্রভাব: নতুন ফ্রন্ট খুলছে কি?
এই পদক্ষেপে রাশিয়া শুধু ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানেই নয়, বরং আর্থিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে নতুন ফ্রন্ট খোলার হুমকি দিচ্ছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা, রুশ ভূখণ্ডে থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের ওপর নজরদারি এবং সাইবার হামলার আশঙ্কা বাড়ছে।
এছাড়া, এই পদক্ষেপ চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতেও প্রভাব ফেলতে পারে, যারা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে আগেই প্রশ্ন তুলেছে।
এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কী ধরনের নজির তৈরি করতে পারে তা নিয়ে। আগ্রহী?
এই ঘটনার আন্তর্জাতিক আইনগত ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আরও গভীর বিশ্লেষণ
রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদের সুদ দিয়ে অস্ত্র কেনা: আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক নজিরের দৃষ্টিকোণ
১. আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সম্পদের মর্যাদা
আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপ্রবাহযোগ্যতা (sovereign immunity) নীতির আওতায়, এক রাষ্ট্রের সম্পদ অন্য রাষ্ট্র কর্তৃক জব্দ বা ব্যবহার সাধারণত নিষিদ্ধ। তবে যুদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা জাতিসংঘ সনদের অধীনে নিরাপত্তা হুমকির ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও তার মিত্ররা যুক্তি দিচ্ছে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, এবং তাই তার সম্পদের সুদ ব্যবহার “ক্ষতিপূরণমূলক ন্যায্যতা” হিসেবে বৈধ। কিন্তু এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
২. নজিরবিহীনতা ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
এই পদক্ষেপ একটি নজিরবিহীন ঘটনা, কারণ এর আগে কখনো কোনো দেশের জব্দকৃত সম্পদের সুদ সরাসরি অস্ত্র কেনার জন্য ব্যবহার করা হয়নি। এটি ভবিষ্যতে অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে যেমন-তাইওয়ান, কাশ্মীর বা গাজা-পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ন্যায্যতা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো BRICS দেশগুলো ইতিমধ্যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থাকে “রাজনৈতিক অস্ত্রায়ন” বলে সমালোচনা করেছে। এই পদক্ষেপ তাদের সেই অবস্থানকে আরও জোরালো করতে পারে।
৩. আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ও যুদ্ধক্ষতিপূরণ
ইউক্রেন ইতিমধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করেছে। যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপ সেই আইনি লড়াইকে আর্থিক ও কৌশলগত সমর্থন দিতে পারে। তবে ICC এখনো রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে সরাসরি নির্দেশনা দেয়নি, ফলে এটি আইনি ধূসর অঞ্চলে পড়ে।
৪. রাশিয়ার পাল্টা কৌশল: হাইব্রিড যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক প্রতিশোধ
রাশিয়া এই পদক্ষেপের জবাবে হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল-যেমন সাইবার হামলা, প্রোপাগান্ডা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা-ব্যবহার করতে পারে। ব্রিটিশ কোম্পানি ও নাগরিকদের রাশিয়ায় থাকা সম্পদ বা বিনিয়োগ এখন ঝুঁকির মুখে।
এছাড়া, রাশিয়া চীন ও ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট আরও জোরদার করতে পারে, যা পশ্চিমা জোটের জন্য নতুন কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
এই বিশ্লেষণকে আপনি চাইলে আরও বিস্তৃত করতে পারেন-যেমন, ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনে এই অর্থনৈতিক কৌশলের ভূমিকা, বা জাতিসংঘের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া। আপনি কি চান আমি সেই দিকগুলোও যুক্ত করি?
ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন এবং জাতিসংঘের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া-এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ্লেষণ করেছি, যা যুক্তরাজ্যের পদক্ষেপকে আরও বিস্তৃত ভূরাজনৈতিক ও নীতিগত প্রেক্ষাপট
৫. ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন: অর্থনৈতিক কৌশলের নতুন দিগন্ত
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেশটির অবকাঠামো, শিল্প, কৃষি ও জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউরোপীয় কমিশনের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে প্রায় $৪১১ বিলিয়ন। এই বিপুল অর্থের উৎস কী হবে, তা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে বিতর্ক চলছিল।
যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপ-রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদের সুদ দিয়ে অস্ত্র কেনা-একটি প্রাথমিক দৃষ্টান্ত তৈরি করল, যা ভবিষ্যতে পুনর্গঠন তহবিলেও এই সম্পদ ব্যবহারের পথ খুলে দিতে পারে। ইউক্রেন ইতিমধ্যে দাবি করেছে, রাশিয়ার মূল সম্পদও বাজেয়াপ্ত করে তা পুনর্গঠনে ব্যবহার করা উচিত।
তবে এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করছে। অনেক দেশ আশঙ্কা করছে, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক মতভেদ বা সংঘাতের কারণে তাদের সম্পদও একইভাবে জব্দ হতে পারে।
৬. জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক নীতিগত দ্বন্দ্ব
জাতিসংঘ এখনো এই পদক্ষেপ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি, তবে এর আইনবিভাগ (Office of Legal Affairs) এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও সম্পদের নিরাপত্তা একটি মৌলিক নীতি।
তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, যা এই পদক্ষেপকে নৈতিকভাবে সমর্থন করতে পারে। তবুও, চীন ও রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা জাতিসংঘকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
জাতিসংঘের কিছু সদস্য রাষ্ট্র এই পদক্ষেপকে “নির্বাচনী ন্যায়বিচার” (selective justice) হিসেবে দেখছে-যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে তা উপেক্ষা করে।
এক নজির, বহু প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপ শুধু একটি সামরিক সহায়তা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, আইন ও কূটনীতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এটি যেমন ইউক্রেনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে, তেমনি ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ও নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করতে পারে।
এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে-পশ্চিমা জোট কতটা ঐক্যবদ্ধ থাকে,
রাশিয়া কীভাবে পাল্টা কৌশল নেয়,এবং জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালত কী অবস্থান নেয়।