বিচার হবে বিচার হবে না
উ
খন্দকার রাকিব facebook পোস্ট থেকে :
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে সকল রাজনৈতিক গোষ্ঠী, সিভিল অর্গান, বিদেশী সংস্থা, এমনকি ভিক্টিম পরিবারগুলো গুম এবং জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এইটা ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি দেশের সামগ্রিক আইন এবং বিচার প্রক্রিয়ার জন্য একটা কালেক্টিভ বার্ডেন।
পৃথিবীর বড় আকারে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে যেসব দেশে ট্রায়াল হয়েছে কোথাও এইসব ট্রাইবুনালে শত শত গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। বরং কমান্ড রেস্পন্সিবিলিটি থেকে শুরু করে একদম বড় পর্যায়ের অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার হয়েছে। সিয়েরালিওন, বসনিয়াসহ নানান দেশে সর্বোচ্চ শ খানেক কেইসের মীমাংসা হয়েছে, তাও প্রায় দশকজুড়ে তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ার পর।
বাংলাদেশে জুলাই ছাড়াও গুম, নির্বিচারে বিচার বহির্ভুত হ*ত্যা, পায়ের গোড়ালি শু*ট থেকে যেসব ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে এইটার আকার এবং ধরণ ব্যাপক, এবং প্রায় সারা দেশজুড়েই দশক ধরে এসব অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত পেনাল কোডেই এসব অমীমাংসিত অপরাধের বিচার সম্ভব।
এছাড়া বাংলাদেশে গণহত্যা(মাস কিলিং), জাতিনিধন (জেনো*সাইড), মানবতাবিরোধী অপরাধ এইসব আইনি শব্দের সূক্ষাতিসূক্ষ পার্থক্য জনসাধারণের অনেকেই পরিষ্কার না। সকল ফৌজদারি অপরাধ মাত্রেই মানবতাবিরোধী অপরাধ না। মানবতাবিরোধী হতে হলে সেই অপরাধ সিস্টেমেটিক এবং ওয়াইডস্প্রিড হতে হবে। ফলে জুলাইয়ের সময়ে বা আগ পরে দেশজুড়ে ঘটা ব্যাপক সহিংসতার অনেক অপরাধ ই পেনালে কোডে দন্ডনীয় হলেও, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের জুরিসডিকশানেও অনেক সহিংসতা পড়ে না। আবার পড়লেও অনেক মামলা সময় অর্থ জনবলের অভাব এবং অপরাধের মাত্রা ধরণ ভেদে অপরাধ আদালতে নিয়ে আসলে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করবে। ফলে ভিক্টিমদের, এবং সংগে দীর্ঘায়িত বিচার প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তদের ন্যায়বিচার পাওয়া দুরুহ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের সরকারের উচিত দেশজুড়ে সকল জুডিশিয়াল কোর্টগুলাতে এক্সিস্টিং পেনাল কোডেই আলাদা করে জেলা বা ক্ষেত্রবিশেষে বিভাগীয় পর্যায়ে জুলাইসহ বড় বড় অপরাধগুলোর বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল করা। যেহেতু এসব বিদ্যমান পেনাল কোডেই বিচার সম্ভব, ফলে তেমন বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ ফেইস করার কথাও না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত কমপক্ষে ২০০০-৫০০০ নতুন জাজ নিয়োগ করা। বড় আকারে তদন্ত অফিসার নিয়োগ করা, স্বল্পমেয়াদি ট্রেনিং এ। বাংলাদেশের এইসব ভায়লোন্সের ঘটনা যথাযথভাবে এড্রেস না করলে মামলাবাজির বর্তমান এই ভীতিকর সাইকেল চলতে থাকবে। বিদ্যমান কাঠামোতে নিজেদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের লিগ্যাল রিপারেশান না ফেলে ভিক্টিমরা-ই দেখা যাবে, আসামীদের নানান ধরণের দীর্ঘায়িত মামলার ঝটে ফেলে আঁটকে রাখবে ।
কেন ভীতিকর সাইকেল বলছি, এবং এইটাকে উইপোনাইজ করা কিভাবে সহজ হবে? সম্প্রতি কয়জন ব্যক্তির সাথে আলাপ করি যারা জুলাইয়ের সহিংসতার ঘটনায় শ খানেকের বেশী লোকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এত বড় আসামীসংখ্যা জিজ্ঞেস করতেই বাদী হবিগঞ্জের স্থানীয় যুবদলের একজন কর্মী চিতকার দিয়ে উঠে,” আপনি নিজে কখনো আসামী হয়েছেন? থাকেনতো বাইরে। আমি যেদিন জুলাইতে রাস্তায় নামি, আমার এলাকা দেখি কারবালা। কয়েকশর বেশী আসামী গু*লি নিয়ে শোডাউন করেছে। গু*লি করেছে। এরপর উলটো আমাদের শত শত লোকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমার পক্ষে এত মানুষতো আইডেন্টিফাই করা সম্ভব না। ফলে আমি গণহারে না, যতটুকু পেরেছি দিয়েছি। কিন্তু এরপরও সবাইকে নিয়ে আসতে পারিনি”|
এরপর উনি আমাকে ভিডিও দেখান আসামীদের, , ঘটনার সময়ের। ছবি ভিডিও একবার স্ক্রল করেই বুঝতে পারি আসামীদের সংখ্যা গণনা করা দুঃসাধ্য । অসংখ্য। অনেকের হাতে অস্ত্র , অনেকের হাতে দেখি দেশীয় অস্ত্র ফিকল, অনেকের হাতে চাইনিজ কুড়াল। লম্বা তদন্তের বিষয়। এবং এই মামলার প্রায় প্রতিটা অভিযোগ-ই বাংলাদেশের বিদ্যমান পেনাল কোডের ৩০২ ছাড়াও ৩৪ ধারায় অপরাধ। বাদী আলাপ করছেন, ভিডিওতে আসামী সংখ্যা হাজার খানেকের বেশি হলেও তিনি মাত্র ১১৬জনের নাম দিয়েছেন।
দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনায় দেখি, বিসিয়াইসি কলেজের ছাত্র শহীদ রাইয়ানের বাবা গোলাম রাজ্জাক নিজেই বাদী হয়ে অন্তত ৩২ জন সাংবাদিককে সরাসরি অভিযুক্ত করে মামলা করেন, প্রায় মোট ৫২ জনসহ। মামলার বিবরণে তিনি লিখেন, সহিংসতার সময়ে এসব সাংবাদিক রাজনীতিবিদদের ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে হ*ত্যাযজ্ঞে প্ররোচনা করে। মামলার বিবরণে সাংবাদিকদের বিষয়ে অভিযোগে বলা হয়, “২০ থেকে ৫২ নং আসামিরা আওয়ামীলীগ সরকারের চাটুকার ও দালাল সাংবাদিক এবং অনলাইন এক্টিভিস্ট। আওয়ামীলীগ ও আইনশৃলা বাহিনী কর্তৃক সংগঠিত মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যাকে বৈধতা দেয়া, প্ররোচনা ও উস্কানি দেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাদের দাবি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যা খবর প্রচার করে। আহত-নিহতদের সঠিক তথ্য গোপন করার পাশাপাশি টক শো করে, কলাম লিখে ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সত্য আড়াল করে গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে। আন্দোলন চলমান অবস্থার তারা আসামী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে ‘আমরা আপনার সাথে আছি’ বলে সরাসরি গণহত্যার প্ররোচনা ও উনি দেয়। সেখানে আসামীরা শেখ হাসিনার সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করে। আলাপে তারা বলেন, তারা শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। এই সম্পর্কে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা কর্তৃক ‘নাশকতার ঘটনার অপরাধীদের ছাড় না দেওয়ার দাবি’ জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিকদের শিরোনামে ২৮/০৭/২০২৪ তারিখ খবর প্রকাশিত হয়। একই বিষয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই আছেন’ শিরোনামে একটি নিউজ দি ডেইলি ক্যাম্পাস নামে অনলাইন পত্রিকার ২৫/০৭/২০২৪ তারিখ প্রকাশিত হয়।” মামলার বাদীর অভিযোগনামা মোতাবেক এইটা খুব ই কষ্টসাধ্য ব্যাপার যে কোর্টের পক্ষে তদন্ত ছাড়া হুট করে আসামীদের নাম কমিয়ে দেয়া ।
ফলে দেখা যাচ্ছে গণ মামলা যে হচ্ছে এইটার নানাবিধ দিক আছে । শুধু মাত্র তদবির, বাণিজ্য , বিরোধী চিন্তার দমন না, অনেকে মামলা করতেছে নিজেই ভিকটিম হয়ে। প্রথম আলোর নিজের ই ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট একটা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সারাদেশে ২৮৬টি মামলা দায়ের করা হয় জুলাইয়ের সময়ে, যার ফলে ৪৫০,০০০ জন ছাত্র-প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে প্রায় ১২,০০০ জনকে গ্রেফতার ও হেফাজতে নেওয়া হয়, যেখানে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এসব মামলার ভিকটিমরা জেল থেকে বের হয়ে অনেকেই একই কায়দায় আবার মামলা করেছেন।
সম্প্রতি ইরেশ জাকের, তুরিন আফরোজসহ প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে জুলাইয়ের মামলার পরে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এসব মামলাকে কিভাবে উইপোনাইজ করা হচ্ছে; এবং একই সাথে মানুষের সম্পদ এবং সম্মান কুক্ষিগত করা হচ্ছে সেটা নিয়ে আলাপ করছে। এইটা খুব ই জরুরি আলাপ , এইসব মামলা যাতে কোনভাবেই বিরোধী চিন্তার মানুষদের দমনের হাতিয়ার আকারে উইপোনাইজ না হয় সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের তরফ থেকে জরুরি। প্রতিটা নিপীড়নের সত্যা উদ্ঘাটন করে, যথাযথ পারপিট্রেটরদের আইডেন্টিফাই করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া এইটা জরুরি । কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি সেটার জন্য প্রস্তুত? তার কি যথেষ্ট রিসোর্স, ম্যানপাওয়ার আছে এসব তদন্ত , বিচার এবং মীমাংসা করার? কোন রোডম্যাপ বা প্ল্যান আছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে? নাকি জাস্ট পাবলিক আউটক্রাই হওয়ার পর কয়েকদিন আলাপের পর চুপসে যাওয়া।
বিচার নিয়ে যথাযথ রোডম্যাপ সেট না করে সরকার উল্টো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রতি প্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সাথে সরকারের সকল অরগ্যানও।
এসবের জন্য সরকারের অপরাধ আদালতের উপর এক্সক্লুসিভ নির্ভরশীলতা কমাতে হবে । সেখানে শুধুমাত্র মানবতাবিরোধি অপরাধের বড় বড় সহিংসতার এবং কমান্ড রেস্পন্সিবিলিটির বিচার করাটা গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত।
বাকী অপরাধগুলোর জন্য দেশের বিদ্যমান পেনাল কোডের মাধ্যমেই জুলাই এবং অন্যান্য সহিংসতার জন্য দ্রুত বিচার ট্রুবুনাল করে বিচার এবং একই সাথে সমাজে রিকনসিলিয়েশানের রাস্তা তৈরির যথাযথ রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি । বিচার মাত্রেই যাতে বিরোধী চিন্তার মানুষদের কালেক্টিভ পানিশমেন্ট না হয়ে রাষ্ট্রগঠনের এবং রাজনৈতিক মীমাংসার একটা ফয়সালা তৈরির রাস্তা হয় সেটাও নিশ্চিত জরুরি। রাষ্ট্র যদি এখনই ভুক্তভোগীদের নিপীড়ন এড্রেস না করে এবং যত বেশি দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁদে এইসব অপরাধের ঘটনা আটকে রাখবে, রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াও ততই দুর্বল হয়ে উঠবে।