মূলধন সক্ষমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে বাংলাদেশ
অনলাইন ডেস্ক
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন ধরে চাপা থাকা বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাত এক নজিরবিহীন সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে আর্থিক অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো
খেলাপি ঋণের বিশাল বোঝা প্রকাশ পাওয়ার পর ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতি প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এর ফলে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত সীমার অনেক নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন’ অনুযায়ী, ২০২৪ সাল শেষে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধনের অনুপাত (ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও বা সিআরএআর) মাত্র ৩.০৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বিপরীতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই অনুপাত ছিল ১৬.৭ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০২৪ সাল শেষে শ্রীলঙ্কায় ১৮.৪ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২০.৬ শতাংশ ছিল। এমনকি নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলোতেও এই অনুপাত ১০ শতাংশের অনেক উপরে রয়েছে।
সহজ ভাষায় সিআরএআর হলো, একটি ব্যাংকের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে যে ঝুঁকি তৈরি হয়, তার বিপরীতে ব্যাংকটির মূলধনের পরিমাণ। এই অনুপাত যত বেশি হয়, ব্যাংকটির আর্থিক আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তত শক্তিশালী বলে ধরে নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ন্যূনতম ১০ শতাংশ সিআরএআর এবং অতিরিক্ত ২.৫ শতাংশ আপৎকালীন সুরক্ষা মূলধন (বাফার ক্যাপিটাল) রাখতে হয়। বাংলাদেশ এখন এই মানদণ্ড থেকে যোজন যোজন দূরে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বরাবরই কম ছিল, যা গড়ে প্রায় ১১ শতাংশের কাছাকাছি থাকত। কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই অনুপাতের ব্যাপক পতন ঘটে। এক বছর আগের ১১.৬৪ শতাংশ থেকে এটি সাড়ে আট শতাংশীয় পয়েন্টের বেশি কমেছে।
অভিজ্ঞ ব্যাংকার এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, এই দুর্বলতা কাঠামোগত। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিক মূলধনের পরিমাণ খুবই কম ছিল।’ তিনি উল্লেখ করেন, প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর জন্য এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ কোটি টাকা। আমানত ও ঋণের চাহিদা দ্রুতগতিতে বাড়লেও নতুন শেয়ার ইস্যু বা মুনাফা থেকে মূলধন না বাড়িয়ে লভ্যাংশ প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাল মেলাতে পারেনি।
আনিস এ খান আরও যোগ করেন, ‘স্বল্প মূলধন ভিত্তির কারণে ব্যাংকগুলো আর ঋণ দিতে পারবে না। এই নিম্ন অনুপাত এটাই প্রমাণ করে যে, তাদের আমানত শেষ হয়ে গেছে এবং তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ভালোভাবে কার্যক্রম চালাতে পারছে না।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বড় ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়া এবং তাদের জামানতের মূল্য কমে যাওয়া মূলধন পর্যাপ্ততার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মাত্র ৪২টি ব্যাংক সিআরএআর-এর শর্ত পূরণ করতে পেরেছে। এই ব্যাংকগুলো দেশের মোট সম্পদের ৫৯ শতাংশ এবং মোট দায়ের ৫৭ শতাংশ ধারণ করে। বিপরীতে, শর্ত পূরণ করতে না পারা ব্যাংকগুলোর হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ৪১ শতাংশ এবং মোট দায়ের ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ, এই দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।
শুধুমাত্র বিদেশি ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সীমার অনেক উপরে তাদের অনুপাত বজায় রাখতে পেরেছে। অন্যদিকে, প্রচলিত ধারার বেসরকারি ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সীমার কাছাকাছি রয়েছে। তবে সরকারি এবং শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবনমন ঘটেছে।
ব্যাসেল-৩ কাঠামোর অধীনে ব্যাংকগুলোকে ন্যূনতম ১০ শতাংশ মূলধনের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২.৫০ শতাংশ বাফার মূলধন বজায় রাখতে হয়। এই শর্ত পূরণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং শিল্প ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাফার মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৬৪ শতাংশ।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ইসলামি ব্যাংকগুলোতে। এই ধারার ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত সিআরএআর ২০২৩ সালের ১২.৭১ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ঋণাত্মক ৪.৯৫ শতাংশে পর্যবসিত হয়েছে। মূলত সাতটি ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ লোকসানের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) অবস্থা আরও শোচনীয়। ২০২৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের অনুপাত ৩১.৫৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৩.৮৩ শতাংশ হয়েছে এবং তাদের সিআরএআর ঋণাত্মক ৬.৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপ সহনশীলতা পরীক্ষা (স্ট্রেস টেস্ট) অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনও অত্যন্ত ভঙ্গুর। এই পরীক্ষা বলছে, দেশের শীর্ষ দুই ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে এই খাতের সহনশীলতার ওপর সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।