
রবিবার, ১০ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » রাজনীতি » মানুষের মুক্তি একমাত্র বাম প্রগতিশীল যুক্তফ্রন্টের হাতেই- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মানুষের মুক্তি একমাত্র বাম প্রগতিশীল যুক্তফ্রন্টের হাতেই- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা আবারও এক সঙ্কটময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। বিগত চরম ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন আমাদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর যেমন যুক্তফ্রন্ট গঠনের ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছিল, তেমনি ২০২৪-এর এই পরিবর্তনের মুহূর্তেও বাম, প্রগতিশীল ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তোলার অপরিহার্যতা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক বছর পেরিয়ে গেলেও এই ঐক্য বাস্তবায়িত হয়নি। এর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন বুর্জোয়া শক্তি—ধর্মনিরপেক্ষ বুর্জোয়া, সেক্যুলার বুর্জোয়া, নন-সেক্যুলার বুর্জোয়া এবং ধর্মব্যবসায়ী বুর্জোয়া—তাদের ক্ষমতার ভিত্তি আরও শক্তিশালী করছে।
আজ এমন এক লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আলবদর–রাজাকারদের ছবি টানানোর মতো অপমানজনক ঘটনা ঘটছে। ইতিহাস বিকৃতির এই প্রচেষ্টা কাকতালীয় নয়—এটি বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনরুত্থানের লক্ষণ।
সরকার পতন বিপ্লব নয় — আসল বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব
মার্কস যেমন বলেছিলেন, “দার্শনিকরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যা করেছে; কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তন করা” — আমরা ভুলে যাচ্ছি যে সরকার পরিবর্তন কখনোই প্রকৃত বিপ্লব নয়। ২০২৪-এর এই ঘটনাকে অনেকে ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করলেও এটি কেবল একটি শাসকগোষ্ঠীর পতন মাত্র। প্রকৃত বিপ্লব হবে তখনই, যখন উৎপাদনের উপায়গুলোর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি হবে, যখন শ্রমজীবী মানুষের শোষণ শেষ হবে।
আজকের বাংলাদেশ বাস্তবে ধনী গোষ্ঠীর উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। বহুজাতিক কর্পোরেশন ও তাদের দেশীয় দালালরা এই উপনিবেশ শাসন করছে—সম্পদ লুট করছে, মুনাফা পাচার করছে। ফ্যাসিবাদ শেষ হয়নি; বরং পুঁজিবাদী ফ্যাসিবাদ নতুন আকারে, আরও ভয়ংকরভাবে ফিরে এসেছে। এর পেছনে আছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলের চাপ।
কাজ একটাই — যুক্তফ্রন্ট গঠন
ঐতিহাসিকভাবে আমরা জানি, বিভক্ত বাম আন্দোলন কখনোই সফল হয় না। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট ছিল একটি শিথিল ও বিক্ষিপ্ত মঞ্চ, যা বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষার ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। আজকের দিনে প্রয়োজন এক ভিন্ন ধরণের যুক্তফ্রন্ট—একটি দৃঢ়, বিপ্লবী, মতাদর্শভিত্তিক ফ্রন্ট, যা সমাজতন্ত্র ও সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী সব শক্তিকে একত্র করবে।
লেনিন রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের সময় বলেছিলেন—“ঐক্য ছাড়া আমরা কেবল হারব”। আজ বাংলাদেশের বাম ও প্রগতিশীল শক্তির জন্যও এটাই মূল বার্তা। ব্যক্তিগত মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও সামাজিক বিপ্লবের লড়াইয়ে আমাদের একসাথে দাঁড়াতে হবে।
ধর্মীয় রাজনীতি যারা করে, তারাও বুর্জোয়া—তারা ব্যক্তিমালিকানার কাঠামো বজায় রাখতে চায়। এই কাঠামো ভাঙতে হলে আমাদের কেবল পুঁজিবাদ বিরোধিতা নয়, বরং সমাজতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তুলতে হবে।
ইতিহাস আমাদের ডাকে
আজকের এই সঙ্কটময় সময়ে বাংলাদেশ যদি বাম প্রগতিশীল যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে ব্যর্থ হয়, তবে ভবিষ্যৎ আবারও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে চলে যাবে। যুক্তফ্রন্ট গঠন কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়—এটি হচ্ছে মুক্তির একমাত্র পথ।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই ফ্রন্টের ওপর। একা, বিচ্ছিন্নভাবে, ছোট ছোট গোষ্ঠীতে লড়াই করলে আমরা কেবল পরাজিত হব। আমাদের হাতে এখনো সময় আছে—কিন্তু ইতিহাস অপেক্ষা করে না।