
বুধবার, ৬ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » অর্থনীতি | রাজনীতি » গণঅভ্যুত্থান নয়, শ্রেণিসংগ্রাম চাই: প্যাসিভ রেভ্যুলুশন থেকে বিপ্লবের দিকে
গণঅভ্যুত্থান নয়, শ্রেণিসংগ্রাম চাই: প্যাসিভ রেভ্যুলুশন থেকে বিপ্লবের দিকে
শফিকুল ইসলাম কাজল লন্ডন থেকে
একটি বছর পার হলো চব্বিশের অভ্যুত্থানের। জনতার বিস্ফোরণ, প্রতিবাদ, রাস্তায় রক্ত-সবই ছিল। কিন্তু আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা রক্ত দিয়েছিল, যারা পা মাড়িয়েছিল রাজপথে, তারা আজও রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ, তাদের ইচ্ছা অপহৃত। শাসকগোষ্ঠী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিজীবী মোর্চা এখন ‘ঐক্যমত’ আর ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ নামে তাদের দাবি হাইজ্যাক করছে। এই প্রক্রিয়াই গ্রামসি যাকে বলেছেন “প্যাসিভ রেভ্যুলুশন”, লেনিন যাকে বলতেন বুর্জোয়ার প্রতিক্রিয়াশীল পুনর্গঠন, আর চারু মজুমদার বলতেন বিপ্লবচ্যুতি।
রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র: ধোঁকা নয়, বাস্তব বোঝা দরকার
রাষ্ট্র কখনোই নিরপেক্ষ নয়। এঙ্গেলস ও লেনিন স্পষ্টভাবে বলেছেন, রাষ্ট্র হচ্ছে শাসকশ্রেণির দমনযন্ত্র। যারা গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রকে অপরিবর্তিত রেখে কেবল শাসক বদলের রাজনীতি করে, তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ আড়াল করে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা বদলের নামে কৌশল নিচ্ছে, তারা জনগণের শ্রেণিসংগ্রামকে প্রতিস্থাপিত করছে শ্রেণি-আপোষ দিয়ে।
প্রশ্ন হচ্ছে:
মজুরের ন্যূনতম মজুরি কি নির্ধারিত হলো?
কৃষক কি চাষের উপকরণে মুক্তি পেল?
নারী কি তার নিজস্ব কণ্ঠ তৈরি করতে পারলো?
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কি ক্ষমতার কাঠামোতে প্রবেশ করতে পারলো?
উত্তর যদি “না” হয়, তাহলে আমরা কোনো ‘গণতান্ত্রিক অগ্রগতি’র মধ্যে নই-আমরা রাষ্ট্রীয় শ্রেণিশক্তির নতুন কৌশলের ভেতর আছি।
হেজিমনি নয়, শ্রেণিশক্তির সংঘর্ষ
গ্রামসি যখন হেজিমনির কথা বলেন, তখন তা শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের প্রশ্ন। কিন্তু লেনিন বলেন, ক্ষমতার প্রশ্ন হচ্ছে শ্রেণির প্রশ্ন। বুর্জোয়া হেজিমনির বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের হেজিমনি তখনই প্রতিষ্ঠা হয়, যখন নেতৃত্ব রাষ্ট্রযন্ত্র ভাঙার লক্ষ্য স্থির করে। এই অভ্যুত্থানে সেই দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত ছিল।
বর্তমানে যে কথিত ‘ঐক্যমত’ তৈরি হচ্ছে, তা মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব মাত্র। নিম্নবর্গ - শ্রমিক, কৃষক, নারী, তরুণ - কেউ এর কেন্দ্রে নেই।
এভাবে একটি বিপ্লবাত্মক অভ্যুত্থানকে ধীরে ধীরে প্যাসিভ রেভ্যুলুশনে রূপান্তর করা হয়েছে।
চারু মজুমদারের শিক্ষা:
চারু মজুমদার বারবার বলেছেন -
“জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে। কৃষক শ্রেণির উপর নির্ভর না করে, শ্রমজীবী মানুষের শক্তিকে ভিত্তি না করে, সশস্ত্র সংগ্রামের পথে না হাঁটলে কোনো বিপ্লব সম্ভব নয়।”
তিনি জোর দিয়েছিলেন তিনটি বিষয়ের উপর:
১. রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াই
২. অর্গানিক বুদ্ধিজীবী ও নেতৃত্ব তৈরি
৩. সশস্ত্র সংগ্রাম ও দলগত সংগঠন
আজ চব্বিশের অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তিরা সেই তিনটি ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়েছে।
তাদের নেতৃত্ব হাইজ্যাক হয়েছে
তাদের লড়াই সংগঠিত হয়নি
তাদের চেতনা বিনাশ করার চেষ্টা চলছে
করণীয়: প্যাসিভ রেভ্যুলুশন ভেঙে ফেলা
আমাদের বুঝতে হবে-এই মুহূর্তে দরকার:
রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রকে চিহ্নিত করা
মধ্যবিত্ত ‘ঐক্যমতের’ বেসামরিক কৌশলকে প্রত্যাখ্যান করা
শ্রমিক-কৃষক-নারী-তরুণ জনগণের ভিত্তিতে একটি র্যাডিক্যাল রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করা
‘চেয়ার নয়, ক্ষমতা চাই’-এই চারুবাদী শ্লোগান ফিরিয়ে আনা
অর্গানিক বুদ্ধিজীবী দল গড়ে তোলা, যারা শিক্ষিত হয়ে জনগণের মুখপাত্র হবে, বিক্রিত হবে না
চব্বিশের ইন্তিফাদা ছিল স্পার্ক। তা আন্দোলন ছিল, কিন্তু বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব তখনই হবে যখন রাষ্ট্রযন্ত্র ভাঙার লক্ষ্যে একটি সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রামের সংগঠন গড়ে উঠবে।
আমরা চাই আরেকবার জাগরণ, কিন্তু এবার তা হবে শ্রেণিভিত্তিক।
আমরা চাই নেতৃত্ব, কিন্তু তা আসবে নিচ থেকে-নিম্নবর্গ থেকে।
আমরা চাই বিপ্লব, কিন্তু তা হবে ধ্বংসের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের বিপ্লব।
এই যাত্রায় দরকার তাত্ত্বিক স্পষ্টতা, রাজনৈতিক সংগঠন, আর জনতার অবিচল সংগ্রাম।
শ্রেণি সংগ্রামই ইতিহাসের চালিকাশক্তি।
আন্দোলন বাঁচে তাত্ত্বিক স্পষ্টতায়
বিপ্লব আসে শ্রেণিসংঘর্ষে
গর্জে উঠুক নিচের সারির কণ্ঠ-ক্ষমতা দখলের জন্য।
শ্রেণি-চেতনা জাগ্রত করার মতো একটি র্যাডিক্যাল রাজনৈতিক বার্তা।