শিরোনাম:
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

Daily Pokkhokal
বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » শিক্ষা ও ক্যারিয়ার » গরুর গাড়িতে রাজস্ব যাত্রা: যশোর থেকে কলকাতা—ধুলো, কাদা আর পাহারার ইতিহাস..
প্রথম পাতা » শিক্ষা ও ক্যারিয়ার » গরুর গাড়িতে রাজস্ব যাত্রা: যশোর থেকে কলকাতা—ধুলো, কাদা আর পাহারার ইতিহাস..
৬ বার পঠিত
বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

গরুর গাড়িতে রাজস্ব যাত্রা: যশোর থেকে কলকাতা—ধুলো, কাদা আর পাহারার ইতিহাস..

..ই---

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। বাংলা তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন। যোগাযোগ ব্যবস্থা নগণ্য, রাস্তাঘাট কাঁচা, বর্ষায় কাদায় থলথলে হয়ে যাওয়া পথ—তবু থেমে থাকেনি প্রশাসনিক কার্যক্রম। আর এই প্রেক্ষাপটেই শুরু হতো এক কঠিন, দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা—যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত গরুর গাড়িতে করে সরকারি অর্থ পরিবহনের অভূতপূর্ব এক অভিযান।

যশোর ছিল সেই সময়কার একটি গুরুত্বপূর্ণ নীলচাষ ও রাজস্ব আদায়কেন্দ্র। এখানে ব্রিটিশদের নিয়োজিত কর্মকর্তারা রাজস্ব, জরিমানা, নীলচাষের অর্থ ইত্যাদি সংগ্রহ করে জমা রাখতেন। কিন্তু প্রশ্ন ছিল—এই বিপুল অর্থ কলকাতায় কীভাবে পৌঁছানো হবে?

১৮১০ থেকে ১৮৫২ সাল নাগাদ, ব্রিটিশ সরকার এই অর্থ প্রেরণের জন্য তৈরি করে এক সুশৃঙ্খল ও কৌশলভিত্তিক ব্যবস্থা। অর্থ সিন্দুকে ভরে গরুর গাড়িতে চাপিয়ে পাঠানো হতো কলকাতার দিকে, সশস্ত্র সৈন্যের পাহারায়। যাত্রার শুরু হতো যশোর থেকে। প্রথম গন্তব্য: নাভারনের কাছে বেতনা নদীর পাড়ে যাদবপুর। সেখানেই স্থাপন হতো অস্থায়ী তাবুর ক্যাম্প। ইংরেজ সেনা অফিসার টমাস ম্যাচেলের দিনলিপিতে পাওয়া যায়, কীভাবে সেনারা সেই ক্যাম্প ঘিরে পাহারা দিত, কাফেলার মাঝখানে থাকত ধাতু ও বাঁশে মোড়ানো ট্রেজারি গাড়ি, যেখানে মোটা কাপড়ে মোড়া কাঠের সিন্দুকে থাকত হাজার হাজার টাকার ধনরাশি।

একদিনে এই যাত্রা সম্পন্ন হতো না। বরং দিনে গড়ে ১৫-২০ কিলোমিটার এগিয়ে একেক রাতে একেক স্থানে থামত কাফেলা। যাদবপুরের পর বনগাঁ, তারপর পরের গন্তব্য। তবে এক গরুর গাড়িই যেত না। যশোর থেকে যারা যেত, তারা অন্য মালপত্র নিয়ে আবার ফিরে আসত। ওখান থেকে নতুন গরুর গাড়ি যেত।

প্রতিটি যাত্রাবিরতিতে নতুন করে তাবু গাড়া হতো, আগুন জ্বেলে রাখা হতো মশাল, আর গরুগুলোকে দেওয়া হতো বিশ্রাম। রাতের অন্ধকার ছিল সর্বাধিক বিপজ্জনক—ডাকাতদের তৎপরতা, বনের ভেতর থেকে অতর্কিত হামলার আশঙ্কা, নদীর ধারে জলদস্যুদের আনাগোনা—সবকিছু মিলিয়ে আতঙ্কভরা মুহূর্তে কাটত পুরো কাফেলার রাত।

তখনকার বাংলার প্রকৃতি ছিল অপরূপ কিন্তু কঠিন। কাঁচা মাটির রাস্তা বর্ষায় কাদায় থইথই করত। গরুর গাড়ির চাকা প্রায়শই কাদায় আটকে যেত। উঁচুনিচু জমি, মাঝে মাঝে বাঁশঝাড়, আবার কোথাও দূরে নদীর ভাঙন—প্রকৃতি যেন প্রতিটি পদক্ষেপে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল।

তবু সেনারা দমত না। মাথায় রোদ, পায়ে কাদা, কাঁধে রাইফেল, চোখে সতর্কতা—এই ছিল ব্রিটিশ বা দেশি সিপাহিদের দায়িত্ব। কাফেলায় থাকত ছয় থেকে আট জোড়া গরু, তার সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনের এক অফিসার কিংবা কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয়, যিনি পুরো যাত্রার তদারকি করতেন।

প্রতিটি ট্রেজারি কাফেলা একেকটি ভ্রাম্যমাণ ব্যাংকের মতো। এখানে রাখা অর্থের পরিমাণই বলে দেয়, প্রশাসন এই যাত্রাকে কতটা গুরুত্ব দিত। যশোর অঞ্চলের মতো চঞ্চল নীলচাষ এলাকায় রাজস্ব ছিল বিপুল—লক্ষাধিক টাকা পরিবহণ ছিল কোনো ব্যতিক্রম নয়। সেই অর্থ যে সঠিকভাবে, নিরাপদে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে পৌঁছাবে—তা নিশ্চিত করাই ছিল এই পুরো ব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য।

টমাস ম্যাচেল নিজের দিনলিপিতে লিখেছিলেন—এই অর্থযাত্রা কেবল অর্থ প্রেরণ নয়, বরং প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, সাহসিকতা আর দূরদর্শিতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। প্রহরীদের মধ্যে ছিল সতর্কতা, গরুর গাড়ির চালকদের মধ্যে ছিল ধৈর্য, আর সম্পূর্ণ কাফেলায় ছিল একটি অভিন্ন লক্ষ্য—নিরাপদে অর্থ পৌঁছানো।

আজকের দিনে ব্যাংক ট্রান্সফার, ডিজিটাল লেনদেন, স্যাটেলাইট নির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থার যুগে দাঁড়িয়ে কেউ যদি শোনে, একসময় যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত রাজস্বের টাকা গরুর গাড়িতে করে, কাদা-মাটি পেরিয়ে, তাবু ফেলে, মশাল জ্বালিয়ে পাহারা দিয়ে পৌঁছানো হতো—তবে সেটি গল্প মনে হতে পারে।

কিন্তু ইতিহাস বলে—এই কঠিন বাস্তবতা একদিন ছিল। যেখানে পথই ছিল প্রতিকূল, সময় ছিল মন্থর, কিন্তু দায়িত্ব ছিল পাথরের মতো দৃঢ়। সেই গরুর গাড়ির কাফেলা আজ কেবল ইতিহাস নয়, একটি প্রশাসনিক অধ্যবসায়ের প্রতীক। (ছবি প্রতিকী হিসাবে ব্যবহার হয়েছে।)

সাংবাদিক সাজেদ রহমানের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া

সূত্র: টমাস ম্যাচেলের দিনলিপি, ১৮৫০-৫২

#গরুরগাড়িতেটাকাপাঠানো#



আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)