
রবিবার, ৩ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » রাজনীতি | শিক্ষা ও ক্যারিয়ার » মেট্রোর পিলারে গণজাগরণের রেখাচিত্র: শহরের হৃদয়ে ইতিহাসের পুনর্জাগরণ
মেট্রোর পিলারে গণজাগরণের রেখাচিত্র: শহরের হৃদয়ে ইতিহাসের পুনর্জাগরণ
পক্ষকাল | ঢাকা, বাংলাদেশ
ঢাকার মেট্রোরেল পিলারগুলো এখন আর নিছক অবকাঠামো নয়-এগুলো হয়ে উঠেছে নাগরিক স্মৃতির এক প্রতীক, যেখানে আঁকা হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের দৃশ্যপট, প্রতিরোধের ভাষা, এবং একটি স্বৈরশাসনের পতনের ইতিহাস। বিজয় সরণি স্টেশনের চত্বরে সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া এই গ্রাফিতিগুলো যেন শহরের কোলাহলের মাঝেও এক নীরব অথচ দৃপ্ত বার্তা বহন করছে: জনগণ ইতিহাস রচনা করে, এবং শহর সেই ইতিহাস ধারণ করে।
শিল্পের মাধ্যমে প্রতিরোধের দলিল
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এই শিল্পপ্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “এই গ্রাফিতিগুলো শুধু শৈল্পিক নয়, এগুলো আমাদের রাজনৈতিক স্মৃতির অংশ। এগুলো আমাদের শেখাবে, কীভাবে জনগণ ভয়কে জয় করে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়।”
গ্রাফিতিগুলোর বিষয়বস্তু স্পষ্ট: ১৬ বছরের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ, এবং জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের পতন। প্রতিটি চিত্রকর্ম যেন একটি অধ্যায়, যেখানে রঙ, রেখা, এবং প্রতীক মিলিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সাহস, ক্ষোভ, এবং আশার গল্প।
শহরের কাঠামোয় গণতন্ত্রের ছাপ
মেট্রোরেল পিলার, যা এতদিন ছিল কেবল যাতায়াতের অংশ, এখন হয়ে উঠেছে নাগরিক চেতনার বাহক। শহরের ব্যস্ততম সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা এই পিলারগুলো এখন প্রতিদিন হাজারো পথচারীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে একটি স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, এবং কীভাবে সেই ঐক্যই নতুন ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
বিশ্লেষণ: প্রতীকী রাজনীতি, নাগরিক স্মৃতি ও শহর-পরিকল্পনার পুনরাবিষ্কার
১. শহরকে স্মৃতির ক্যানভাসে রূপান্তর
এই গ্রাফিতি প্রকল্পটি একটি বৃহত্তর প্রবণতার অংশ, যেখানে নগর স্থাপত্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক স্মৃতি ও নাগরিক চেতনার বাহক হিসেবে। বিশ্বজুড়ে বার্লিন, বুয়েনস আইরেস বা কায়রোর মতো শহরগুলোতে দেখা গেছে-যেখানে দেয়াল, সেতু, বা পিলার হয়ে উঠেছে ইতিহাসের দলিল। ঢাকায় এই প্রয়াস সেই ধারারই একটি সাহসী সংযোজন।
২. গণতান্ত্রিক পুনর্দাবি ও প্রতিরোধের নান্দনিকতা
শিল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছানো নতুন নয়, কিন্তু এই গ্রাফিতিগুলো বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এগুলো একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের স্মারক। এগুলো শুধু অতীতের স্মরণ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা-যেখানে জনগণের ঐক্য, সাহস, এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।
৩. নগরপরিকল্পনায় নাগরিক অংশগ্রহণের নতুন দিগন্ত
এই প্রকল্পটি নগরপরিকল্পনার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছে-যেখানে শহরের কাঠামো শুধু কার্যকর নয়, বরং অর্থবহ। এটি প্রশ্ন তোলে: কীভাবে শহর তার নাগরিকদের ইতিহাস, সংগ্রাম, ও স্বপ্নকে ধারণ করতে পারে? এবং কীভাবে নাগরিকরাই শহরের নান্দনিক ও রাজনৈতিক ভাষা নির্ধারণ করবেন?
৪. বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্মৃতিচিহ্নের ভূমিকা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ প্রায়শই দলীয় দখলদারিত্বের শিকার হয়। এই গ্রাফিতিগুলো সেই প্রবণতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, একটি জনগণের ভাষ্য তুলে ধরছে-যেখানে দল নয়, জনগণই ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু। এটি একটি বিকল্প রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয়, যেখানে স্মৃতি, প্রতিরোধ, এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন একত্রিত হয়।