
বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » অর্থনীতি | রাজনীতি » বন্দর করিডর প্রাসঙ্গিক ভাবনা বিদেশি হ্যান্ডেলার
বন্দর করিডর প্রাসঙ্গিক ভাবনা বিদেশি হ্যান্ডেলার
প্রসঙ্গ মানবিক করিডোরঃ চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি হ্যান্ডেলার নিয়োগের কসরত সবই যেন আপনা অঙ্গে হরিণা বৈরী (পর্ব-১)
বেলায়েত হোসেন বেলালঃ
নিকট অতীতে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত বিষয় ছিল এথনিক ক্লিনজিংএ আক্রান্ত রাখাইনে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল দিয়ে মানবিক করিডোর প্রসঙ্গ।
করিডোর প্রদানের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণ, মূলধারার রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর বৃহদাংশ সচেতন আলেম সমাজ কেউই ভালো চোখে দেখছেনা। এর ভিতর বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছে। নিরীহ, স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রিক্সাচালক ভাইটিও জবানবন্ধী দিচ্ছেন মানবিক করিডোরের নামে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করা যাবেনা। আরেকটি বিষয়ে জনগণ আপোষহীন চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি হ্যান্ডেলারদের কাছে বন্দোবস্ত দেয়া যাবেনা।
শুধুমাত্র কতিপয় ইসলাম পছন্দ রাজনৈতিক দল তাদের খুচরো সমর্থক অরাজনৈতিক নামধারী হেফাজতে ইসলাম এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত কিং পার্টি এরা করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি হ্যান্ডেলারকে সোপর্দ করতে জোরালো সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে ইন্টেরিম গভর্নমেন্টকে।
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি হ্যান্ডেলারকে বন্দোবস্ত দেয়ার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার বাণী বিতরণের পক্ষে খুচরো দল এবি পার্টির এক বিতর্কিত নেতা। এদের ঢাল তলোয়ার কিছু নাথাকলেও ইন্টেরিমের কল্যানে জাতির বিরুদ্ধে জঘন্য বার্তা নিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির হয়, মিডিয়া এখন এদেরকে খুব বেশী কাভারেজ দেয় ইচ্ছেয় কিংবা অনিশ্চায়! কিন্তু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ষ্টেক হোল্ডারগণ ও সাধারণ মানুষ তথাকথিত করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি হ্যান্ডেলারকে বন্দোবস্ত দেয়ার প্রস্তাবে এত উদ্বিগ্ন কেন? করিডোর প্রদানের প্রস্তাবের প্রধান হোতা রজার রহমান তথা খলিলুর রহমান বলেন করিডোরের ব্যাপারে কারো সাথে নাকি কোন বাৎ চিৎ হয়নি। অথচ নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির ইন্টেরিমের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, জাতিসংঘ কর্তৃক রাখাইনে মানবিক ত্রান তৎপরতা চালানোর জন্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দিয়ে রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রজার রহমান তথা খলিলুর রহমান আবার কথার পিঠে কথা সাজিয়ে বলেছেন, করিডোর না রাখাইনে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল দিয়ে একটা চ্যানেল বা প্যাথওয়ে দেয়ার কথা সরকার বিবেচনা করছে। করিডোরের সাথে চ্যানেল বা প্যাথওয়ের প্রার্থক্যটা কি সেটা বুঝলামনা। করিডোর বিষয়ে জাতিসংঘ বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা, জাতিসংঘের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফরে এসে বলে গেছেন, যে বাংলাদেশের কাছে জাতিসংঘ কোন করিডোরই চায়নি, বাংলাদেশের ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের কেউ কেউ উপযাচক হয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল দিয়ে রাখাইনের জন্য করিডোরের কথা বলেছে, জাতিসংঘের কর্মকর্তা আবার প্রশ্ন তুলেছেন দ্বিপক্ষীয় সম্মতি নাথাকলে কিভাবে করিডোর দেয়া যাবে যেহেতু এখানে মায়ানমারের সম্মতি নাই। এবার বুঝুন আমরা গায়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি কেন? অবশ্য এসব আত্মঘাতী তৎপরতায় যারা লিপ্ত তারা বাংলাদেশের নাগরিকই নয়।
মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি হ্যান্ডেলারকে বন্দোবস্ত দেয়ার বিষয়ে জনগণের উদ্বেগের বিষয়ে ফিরে আসি, কেন এসব তৎপরতা চলছে? উল্লেখিত বিষয়ে জিও পলিটিকাল বিশেষজ্ঞগণ বহুমুখী উৎসমুখের সন্ধান লাভ করেছেন। এরমধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দখলদারিত্ব, দেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকির আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আবার বিশ্ব মোড়লদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায় বহুমুখী তৎপরতা দৃশ্যমান। সমস্যা সংকটের মূল জ্বালামুখে দুটি বিষয় ; প্রথমত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা অর্জন তাতে বিশাল ধনভাণ্ডার থাকার ধারণাপ্রসূত বিষয়, অন্যটি পূর্ববর্তীটির সম্পর্কিত আনুষাঙ্গিক চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। আলোচনার সার্থে জানতে হবে বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় এবং এর বাস্তবতা, এবং চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ দুটো বিষয়ের সাথে সংযুক্ত কিছু বিষয়কে। আরো জানতে হবে মায়ানমারে রুশ, ভারত ও চীনের কায়েমী সার্থ এর বিপরীতে মার্কিন সার্থের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে।
২০১৬ সালে বঙ্গোপসাগরে তীরবর্তী মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে ভারত একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করে। সিতওয়ে সমুদ্র বন্দর কালাদান নদীর মোহনায় মাল্টি মর্ডান ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট ভারত ও মায়ানমারের সহযোগিতামূলক একটি প্রকল্প। প্রকল্পটি পরিকল্পনা করা হয়েছে মায়ানমারের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর পূর্ব ভারতের অবকাঠামো উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পন্য পরিবহন বিলম্বিত ও অধিক খরছের সমস্যায় নিপতিত। এ রাজ্যগুলিতে পরিহন খরছ ও সময় কমানোর জন্য ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যাবহারের চেষ্টা করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যস্তরে প্রবল বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশের কোন সরকারই ভারতের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারেনি। অবশেষে ২০২৩ সালে ভারত বাংলাদেশ থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যাবহার করে ট্রানজিট সুবিধা পায়। কিন্তু ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা একতরফা দেয়া হয়নি ভারত ও ভারতের স্থল ও বিমান বন্দর দিয়ে বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। অথচ ভারতকে একতরফা ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে কথাটা রটিয়ে তৎকালীন সরকারের বিরোধী পক্ষ সরকারের উলঙ্গ সমালোচনা করেছে। ২০২৫ এ এসে দেখা গেল ভারত বাংলাদেশকে নানাবিধ ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। ভারতের সহযোগিতায় নির্মিত মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যেের সিতওয়ে বন্দরের সাথে মায়ানমার ঘেঁষা ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে। যাতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের উপর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের পরিবহন সুবিধার প্রয়োজনীয়তা আর থাকেনা। এভাবে মায়ানমার ভারতের বিড়াট স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। তাছাড়াও ভারতের হেভী ম্যাটাল শিল্পগোষ্ঠীগুলো মায়ানমারে ভারী শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মায়ানমারে রুশ স্বার্থও জড়িত।
চীন মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কিউয়াকপিউতে একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ সমুদ্র বন্দরটি চীনের রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের অংশ। এ সমুদ্র বন্দরটি চীনের উইউনান প্রদেশের কুনমিংকে কিউয়াকপিউ মান্দালয় এবং ইয়াঙ্গুনের অর্থনৈতিক জোনের সাথে সংযুক্ত করবে।
কিউয়াকপিউ সমুদ্র বন্দরটি চীনকে ভারত মহাসাগরে একটি সংক্ষিপ্ত বানিজ্য পথ প্রদান করবে যা মালাক্কা প্রণালীর উপর চীনের নির্ভরতা হ্রাস করবে। এ সমুদ্র বন্দরটিতে চীনের অংশীদারিত্ব ৭০%, মায়ানমারের অংশীদারিত্ব ৩০%।
চীনের রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের ৬টি করিডোরের একটি করিডোর ট্রান্স হিমালয়ান মাল্টি ডাইমেনশনাল কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক এর অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হল মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য।
চলবে….