
শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশ্ব সংবাদ | সম্পাদক বলছি » ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
–
মো: শহীদুল্লাহ:
ইহুদী ধর্মে জাতির পিতা এবং ইসলাম ধর্মের জাতির পিতা একজনই, হযরত ইবরাহীম (আঃ)
ইবরাহীম (আঃ) এর দুই পুত্র•• ১। ইসহাক (আঃ) ২। ইসমাইল (আঃ)
হয়রত ইসহাক (আঃ) এর পুত্র ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আঃ)। এই ইয়াকুব (আঃ) এর বংশকে আল্লাহ্ তা’আলা বনি-ইসরাইল নামে সম্বোধন করেছেন-
হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর ১২ সন্তানের মধ্যে ১জনের নাম ছিল ইয়াহুদা - এই ইয়াহুদা র বংশ’ই পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে।
তাই, বনি-ইসরাইল এর আরেক নাম ইহুদী।
ইহুদী ধর্ম আর বংশ দুটো আলাদা, সব ইহুদী বংশের লোক ইহুদী ধর্মের হলেও সব ইহুদী ধর্মের লোক’ই ইয়াহুদার বংশ নয়। এই ইয়াহুদা’ই তার আপন ভাই ইউসুফ (আঃ) কে কূপে ফেলে হত্যা করতে চেয়েছিল।
চার হাজার বছর আগে ইসহাক (আঃ) এর মৃত্যুর পর ইয়াকুব (আঃ) আল্লাহ্’র নির্দেশে শ্যামনগরী ( সিরিয়া ) থেকে কেনানে হিজরত করেন। এই কেনান ই বর্তমানের ফিলিস্তিন।
এরপর কেনানে ( ফিলিস্তিন ) দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ইয়াহুদা তার সব ভাই এর সাথে মিশরে চলে যায় এবং মিশরে বসবাস শুরু করে।
মিশরের তখনকার রাজা ছিলেন ইউসুফ (আঃ) যিনি ইয়াকুব (আঃ) এর ১২সন্তানের মধ্যে ১১তম। সেই কারণে ইয়াহুদা ও তার বংশ মিশরে অনেক দাপটের সাথে থাকতে শুরু করে।
তারপর কালের পরিক্রমায় ক্ষমতা যায় ফারাও রাজাদের হাতে। ফেরাউন এসে বনি-ইসরাইলদের এত অত্যাচার শুরু করে যে এরা সারাদিন ” ইয়া নাফসী ” ” ইয়া নফসী ” করতো।
তখন আল্লাহ্ তাদের কাছে পাঠালেন মূসা (আঃ) আর তাওরাত কিতাব। মুসা (আঃ) ফেরাউনকে নীল নদে ডুবানোর মাধ্যমে বনি-ইসরাইল মুক্তি পায়।
তারপর মূসা (আঃ) সবাইকে নিয়ে কেনানে (ফিলিস্তিন) ফিরে যান। পরে তারা সেখানে গিয়ে আল্লাহ্’র অশেষ রহমত পাওয়া সত্ত্বেও মুসা (আঃ) এর ওফাতের পর আবার আল্লাহ্ কে ভুলে যায়, গরু পূজা সহ নানা রকম অনাচার শুরু করে। তাদের মধ্যে ক্ষমতার লোভে নিজেদের একতা ভেঙ্গে যায়। ভিন দেশীরা তাদের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের আবার গোলাম বানিয়ে অত্যাচার করতে থাকে।
১০০ বছর পরে দাউদ (আঃ) আর উনার ছেলে সুলাইমান (আঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা আবারও এই অত্যাচার থেকে তাদের কে মুক্তি দেন।
কিন্তু সুলাইমান (আঃ) এর মৃত্যুর পর ইহুদীরা আবার শয়তানের পূজা শুরু করে। তাদের ভিতরে থাকা ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাওরাত কিতাবের মধ্যে নিজেদের সুবিধা মত সংযোজন-বিয়োজন করার মতন ধৃষ্টতা দেখায়।
তারা তাওরাতে সংযোজন করে যে, “আল্লাহ্ তায়ালা ইসহাক (আঃ) এর স্বপ্নে কেনান কে ইহুদীদের জন্য প্রমিজ ল্যান্ড হিসেবে দিয়েছেন। এটা তাদের জয় করে নিতে হবে,
এটাকে তারা ‘জেকব লেডার ড্রিম’ বলে।
তাদের এমন নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার কারণে তারা বারবার আল্লাহ্’র শাস্তির মুখে পড়েছে যেমনঃ
* কখনো গৃহহীন হয়ে যাযাবরের মতো ঘুরেছে।
* ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্যের দ্বারা গণহ/ত্যার শিকার হয়েছে।
* রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা সিরিয়া থেকে আরব দেশে বিতাড়িত হয়েছে।
মহানবী (সাঃ) এর সময় তারা আরব দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে চলে যায় ইউরোপে, আর উমর (রা:) ফিলিস্তিন ও আল-আকসা বিজয় করেন। ইসরায়েলের এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইউরোপও তখন তাদেরকে আশ্রয় দেয়নি।
বনি-ইসরাইলের এমন পরিণতির কারণ আল্লাহ তায়ালা এর শাস্তির পাশাপাশি তাদের ব্যবহার তখনকার লোকদের ভাষ্যমতে, তারা অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ ছিল। তাদেরকে যে জায়গায় আশ্রয় দেয়া হতো সেই জায়গাতেই তারা তাদের প্রতিবেশীর জমি দখল করতো।
ইহুদীরা বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ছিল, আর তাদের ব্যবসা অন্যদের থেকে কৌশলগত- ভাবে আলাদা ছিল, যার কারণে যাযাবরের মত ঘুরলেও তাদের অর্থ-সম্পদ ভালোই ছিল। সেই অর্থ-সম্পদ এর দাপট দেখিয়ে তারা সেইসব এলাকার স্থানীয় লোকদের উপরই ছড়ি ঘুরাতো। তাই তারা সেই সব এলাকার রাজা ও বাসিন্দাদের দ্বারা বার বার বিতাড়িত হত। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করার পর তারা একসময় বুঝতে পারে যে, যেকোন সমাজ কে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে শিক্ষা ও অর্থের বিকল্প নেই। তাই তারা শিক্ষা অর্জন ও অর্থ উপার্জনের উপর গুরুত্ব দেয়। তারা বিশ্বাস করে, কেনান তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভূমি। তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, একসময় তাদের একজন মসিয়াহ্ (দাজ্জাল) এসে তাদের এই ভূমিকে উদ্ধার করে দিবে।
১৮ শতাব্দীতে ইহুদীরা তাদের ধর্ম-পরিচয় গোপন করে ইউরোপে বসবাস শুরু করে।
তখন থিওডোর হার্জেল নামে তাদেরই একজন ব্যবসায়ী ফিলিস্তিনকে নিজেদের দখলে আনার লক্ষ্যে ১৮৯৭ সালে জিওনিজম আন্দোলন শুরু করে ইহুদীদের কে আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখানো শুরু করে। এই আন্দোলন কে যারা সমর্থন করে, তাদেরকে জিওনিস্ট বলে।
যেহেতু ইহুদী’রা অনেক শিক্ষা ও অর্থ উপার্জন করেছিল, তাই তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষ ইউরোপে ধর্ম গোপন করে থাকলেও কেউ কেউ মেধার জোরে ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করতে, বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। তখন তারা শুধুমাত্র পদ দখল করেই থেমে থাকেনি। সেই সাথে নিজেদের একটা রাষ্ট্র গঠনেও প্রচুর সমর্থন সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে থাকে। তখন ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তাদেরকে আফ্রিকার উগান্ডায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।
ঠিক এমন সময় শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে যুক্তরাজ্য নিজেদের অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য এক ধরনের গ্লিসারিন ইউজ করতো। যেটা আসতো জার্মানি থেকে, কিন্তু যুদ্ধের সময় জার্মানি যুক্তরাজ্যের বিপক্ষে থাকায় গ্লিসারিন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তখন যুক্তরাজ্যকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে চাইম ওয়াইজম্যান নামক একজন ইহুদী গবেষক ও ব্যবসায়ী। তিনি গ্লিসারিন এর বদলে এসিটোন দিয়ে অস্ত্র সংরক্ষণের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন এবং যুদ্ধে প্রচুর অর্থ সহায়তা দেন। তার এমন অভুতপূর্ব অবদানের জন্য যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্য যখন তাকে পুরস্কৃত করতে চায়, তখন সে জানায় যে তার একমাত্র পুরস্কার হবে তাদের প্রমিজল্যান্ড মানে ফিলিস্তিনে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দেয়া। এখানে উল্লেখ্য, চাইম ছিলেন জিওনিজম আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
ফিলিস্তিন তখন ছিল উসমানী সালতানাতের দখলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর তুরস্কের ক্ষমতা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। সেই সুযোগে ধাপে ধাপে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে থাকে।
প্রথমে তারা ফিলিস্তিনি’দের কাছে ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। তারপর বেশি দামের লোভ দেখিয়ে সেগুলো কিনতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজয়ের পর পুরো বিশ্বের ক্ষমতা ইউরোপের হাতে চলে যায়।
ইহুদীরা তখন স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের’কে অত্যাচার-জোর-জবরদস্তি করা শুরু করলে ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করে।
তখনই ইউরোপ থেকে ঘোষণা আসে পুরো ফিলিস্তিনের ৫৫ ভাগ থাকবে ফিলিস্তিনিদের দখলে, আর বাকি ৪৫ ভাগ হবে ইহুদীদের। সম্ভবত ৬ লাখ ইহুদীর জন্য ৪৫% আর ১২ কোটি ফিলিস্তিনির জন্য ৫৫% জায়গা।
জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ইহুদীরা ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। নব গঠিত এই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয় চাইম ওয়াইজম্যান।
ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পরপরই আমেরিকা তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়। আর এভাবেই যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে তারা ইয়াকুব (আঃ) এর সাথে কেনানে আসা যাযাবর থেকে আজকে গাজাকে ধ্বংসকারী দানবে পরিণত হয়েছে। আর বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানেরা মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে বসে আছেন আর চোখে ঠুঁলি পরে সবকিছুকে না দেখার ভান করছেন