শনিবার, ১৩ জুলাই ২০১৯
প্রথম পাতা » বিশ্ব সংবাদ | ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি | সম্পাদক বলছি » স্রোতের বিপরীতে একজন অধ্যাপক ফারুক, রাষ্ট্রের মন্ত্রী সচিব এবং আমরা…
স্রোতের বিপরীতে একজন অধ্যাপক ফারুক, রাষ্ট্রের মন্ত্রী সচিব এবং আমরা…
মে মাসে হাইকোর্ট বাজার থেকে ৫২টা পণ্য সরিয়ে নিতে বলেন। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সরিষার তেল, চিপস, খাবার পানি, নুডলস, হলুদ ও মরিচের গুঁড়া, আয়োডিন যুক্ত লবণ, লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, বিস্কুট এবং ঘি।
মোটামুটি একটা মধ্যবিত্ত সংসারের যাবতীয় সব নিত্যদরকারি পণ্য এসব। তীর, রুপচাঁদা, ফ্রেশ, এসিআই সহ বেশিরভাগই ভাল ব্র্যান্ডের পন্য সেসব। নিম্নমানের এই পন্য বাজার থেকে সরিয়ে ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশনা ছিল। নতুন করে মানোত্তীর্ণ না হলে এসব পণ্য বাজারজাতকরণের নিষেধও করা হয়েছিল।
শিল্পমন্ত্রী এতে দুক্ষু পেয়েছেন। তিনি বলেন, ভুল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এসব পণ্যকে ভেজাল বলা ঠিক নয়। নিম্নমান বলা যেতে পারে। ভেজাল শব্দটা খুবই খারাপ তার মতে।
*
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দুধ নিয়ে গবেষণা করলেন। তিনি দেখালেন এই দুধ সেই দুধ নয়, এই দুধে আছে স্পেশাল ম্যাজিক। এন্টিবায়োটিক সমৃদ্ধ এসব দুধে নাকি ডিটারজেন্ট ও পাওয়া গেছে। ব্র্যান্ডগুলো সব আপনার আমার চেনা, সুপ্রতিষ্ঠিত। মিল্কভিটা, প্রাণ, আড়ং, ফার্মফ্রেশ….
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার এবং ফার্মেসি অনুষদের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে এসব খাদ্যপণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে এসব খাদ্যপণ্যের উপর পরীক্ষাকৃত ফলাফল উপস্থাপন করেছিলেন বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক এবং ফার্মেসি অনুষদের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। একই দিন বিএসটিআই হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। যেখানে তারা দাবি করেে দুধের নমুনায় কোনো ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়নি। অথচ এখন তারাই স্বীকার করছেন দুধে এন্টিবায়োটিক আছে কি নেই এই পরীক্ষা করার মুরোদই তাদের নেই অর্থাৎ এই উপাদানগুলো সনাক্ত করার সক্ষমতা এই মুহুর্তে নেই প্রতিষ্ঠানটির!
অধ্যাপক ফারুক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না, শিক্ষকরা সব অর্থব কাজে সময় ব্যয় করে এই কথা বলতে বলতে অনেকের মুখে লোল পড়ে। কিন্তু একজন সত্যানুসন্ধানী গবেষকের বিড়ম্বনা কি হয় সেটা কি তাদের জানা আছে? তাদের অবগতির জন্য জানাই, এই গবেষণা করার ফলে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরকারের একজন সচিব ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য তো এই গবেষণাকে মিথ্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। তার খুব কষ্ট, দুধকে কেন বলা হয়েছে নষ্ট? তিনি এটাকে দুধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলেও বক্তব্য রাখেন।
তারচেয়ে অবাক করা ব্যাপার খোদ ফার্মেসি অনুষদের চেয়ারম্যান ডিপার্ট্মেন্টের প্যাডে এই বিষয়টি নিয়ে অফিসিয়াল বক্তব্য প্রকাশ করেন। সেখানে বিভাগটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বলেন, মন্ত্রী যে বলেছেন ফার্মেসি অনুষদের গবেষণা ফলাফল মিথ্যা এই দায় বিভাগ নেবে না। ওই গবেষণাটি গবেষকের একান্ত নিজস্ব গবেষণালব্ধ ফল।
কি অসাধারণ না? আমরা প্রশ্ন করতে চাই, এই সমন্বিত লিয়াজুঁ কার স্বার্থে?
অথচ, এখানে গবেষক কিংবা ব্র্যান্ডগুলোর সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার কোনো ব্যাপার নয়। ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, সুনাম অর্জন করেছে তাদের পণ্যের কারণে। সেই পণ্যের মান, গুণগত উপাদান ঠিক রাখা একটি চলমান বিষয়। গবেষকরা এখানে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছেন ব্র্যান্ডগুলো সেটাকে আমলে নিয়ে নিজেদের পরিশুদ্ধ করবে, ভোক্তার কল্যাণে, নিজেদের ব্র্যান্ড সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে। সরকার গবেষণার রিপোর্ট আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় তদারকি করবে। স্বাভাবিকভাবে এটাই হওয়া কি যৌক্তিক নয়?
কিন্তু স্বাভাবিকতা এখন কোথায় আছে? সরকারের প্রতিনিধি এটাকে দিব্যি অপপ্রচার বলে প্রচার করছে। ব্র্যান্ডগুলোও বলছে ইহা অপপ্রচারই বটে। তাদের দুধ খুবই খাঁটি। বরং, গবেষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও কথা উঠেছে, সচিব জানিয়েছেন গবেষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সেই শিক্ষক দ্বিতীয়বার আবারো পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। এবারে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। এবারে দশটি নমুনার দশটিতেই এন্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে! এই হলো অবস্থা। অধ্যাপক আ ব ম ফারুক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, জনস্বার্থে ভবিষ্যতেও এরকম পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে পিছপা হবেন না। তিনি আশা করেন এই গবেষণা দুধ বাজারজাতকরণ কোম্পানিগুলোকে গুণগত মান উন্নত করতে সাহায্য করবে। তিনি এই আশাও করেন, সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থা দুধে পাওয়া এন্টিবায়োটিক হালকাভাবে না নিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা করবে। তিনি মনে করেন, যদি সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়ে তারা কাজ করেন তাহলে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে এসব গবেষণায় বিদেশী চক্রান্ত খুঁজতে হবে না।
কিন্তু, আমরা ভয় করি, যেভাবে নিরীহ একটি গবেষণার ফলকে আক্রমণ করা হয়েছে, প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে সেটার মাধ্যমে কি উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে আসলে? এই শিক্ষক হয়ত বিবেকের তাড়নায় জনস্বার্থে ফলাফল প্রকাশ করেছেন। ভয় হুমকি আমলে নেননি। কিন্তু, আমরা কেউই সরাসরি স্বীকার করি বা না করি, আমরা জানি এখনকার শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া কি, তারা গবেষণার চেয়েও কোন কোন জায়গায় আগ্রহী, শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের চেয়েও বিভিন্ন রঙয়ের রাজনীতির প্রতি কেন তাদের আগ্রহ সেই কথাও কারো অজানা নয়। ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যানের স্ট্যান্ড থেকেই কিছুটা ধারণা আমরা পাই।
এই সময়ে এসে গবেষণার প্রতি আগ্রহের চেয়ে স্রোতের সাথে মিশে বাড়তি সুবিধা আদায় নিয়েই বেশিরভাগের আগ্রহ। এরকম অবস্থায় একজন শিক্ষক যখন স্রোতের বিপরীতে গবেষণা করেন, জনস্বার্থের কথা ভাবেন তাকে হুমকি দেয়া, গবেষণাকে ঢালাওভাবে প্রত্যাখ্যান করা খুব বাজে উদাহরণ। আমাদের তাই অধ্যাপক ফারুকের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা উচিত। আমাদের বার্তা দেয়া উচিত জনস্বার্থে যে কাজ যারাই করবেন জনগণ তার পাশে দাঁড়াবে।