
মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » বিনোদন | রাজনীতি » ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’, মুক্তি প্রতীক্ষিত একটি ভারতীয় সিনেমা। এ সিনেমার মুক্তি নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও বিরোধীদল বিজেপি-দু’পক্ষই কথার শানে তোপ দাগাচ্ছেন একে অন্যের প্রতি। তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সিনেমাটি মুক্তি পেলে রাজ্যের শান্তি বিনষ্ট হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারও আংশকা করছেন কেউ কেউ। এমনিতেই কিছুদিন আগে সিনেমাটির টিজার প্রকাশের পরই শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সেই বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ট্রেলার লঞ্চেও। গত শনিবার (১৬ আগস্ট) কলকাতায় এ নিয়ে শুরু হয় তুমুল হট্টগোল। শহরটির একটি বিলাবহুল হোটেলে এদিন ট্রেলার লঞ্চের অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানেই অনুষ্ঠানের মাঝে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ট্রেলার চলাকালীন স্ক্রিন বন্ধ করে দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। এজন্য রাজ্য সরকারের প্রতি অভিযোগ আনে সিনেমা সংশ্লিষ্টরা। যদিও তৃণমূল বলছে, পেমেন্ট সমস্যার কারণে অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বিজেপি বিষয়টিকে ইস্যু বানিয়েছে। প্রকাশ করেছে তীব্র ক্ষোভ। তবে ট্রেলারটি কিন্তু ছড়িয়ে গেছে ভারতজুড়ে। ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে নানা প্রান্তে পরিচালকের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে এফআইআর। কলকাতা হাইকোর্টের নজরেও এসেছে বিষয়টি। কিন্তু এই একটি সিনেমা নিয়ে কেন পশ্চিমবঙ্গজুড়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ?
কী আছে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এ
ভারতীয় নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রীর ফাইলস ট্রিলজির তৃতীয় সিনেমা হচ্ছে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’। হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছে এটি। সিরিজের প্রথম সিনেমা ছিল ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’ (২০১৯)। দ্বিতীয়টি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ (২০২২)। তৃতীয় অর্থাৎ শেষ কিস্তির নাম ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’। শেষ পর্বটি ১৯৪৬ সালের ‘গ্রেট কলকাতা কিলিংস’র ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। এটি দুভাগে মুক্তি পাবে। প্রথম কিস্তি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস : রাইট টু লাইফ’ পর্দায় আসবে ৫ সেপ্টেম্বর। সিনেমাটির প্লট ১৯৪০-এর দশকে অবিভক্ত বাংলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে পুঁজি করে তৈরি। যেখানে মূলত মুসলমানদের ভিলেন বানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, মুসলিমরাই কলকাতায় দাঙ্গা ঘটিয়েছে। তারাই অসংখ্য হিন্দুদের হত্যা করেছে। জানা গেছে, এ সিনেমায় ১৯৪৬ সালের আগস্টে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-কে ঘিরে সংগঠিত দাঙ্গা ও মর্মান্তিক ঘটনাগুলো চিত্রিত করা হয়েছে, যা ১৯৪৬ সালের ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামেও পরিচিত। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণার পর কলকাতায় যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল, তা ব্যাপক দাঙ্গায় পরিণত হয়। এ দাঙ্গা ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত বলে অনুমান করা হয়, আরও হাজার হাজার আহত হয়। সহিংসতা শিগগিরই নোয়াখালী, ত্রিপুরা (কুমিল্লা), বিহার এবং পাঞ্জাবসহ আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তীব্রতর হয়। যে দাঙ্গা শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা এবং দেশভাগের পথকে উল্লেখযোগ্যভাবে রূপ দেয়। সিনেমাটি প্রাথমিকভাবে ‘দ্য দিল্লি ফাইলস : দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’ নামে ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০২৫ সালের জুনে, নির্মাতা অগ্নিহোত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে নাম পরিবর্তন করে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস : রাইট টু লাইফ’ রাখেন, যা দিল্লির পরিবর্তে বাংলার ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করে।
কী নিয়ে বিতর্ক
২০২২ সালের এপ্রিলে, মহারাষ্ট্র শিখ অ্যাসোসিয়েশন আপত্তি জানিয়ে দাবি করে, সিনেমাটি ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যার বাণিজ্যিকীকরণ করবে। কিন্তু সেই সময় পরিচালক কাহিনির বিবরণ নিশ্চিত করেননি। যদিও কেউ কেউ অনুমান করেছিলেন, সিনোমাটি ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। পরে এটি ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি বলে জানা যায়, যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস নামেও পরিচিত। এ সময়ে এসে শান্তির রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত করে তোলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের একটি গোপন ষড়যন্ত্র বলেও মনে করে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ, বাংলার মানুষ মনে করেন, ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছে ১৯৪৬-র সংহিসতা। অর্থাৎ, ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে বাংলার মানুষ। ভারতের স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরাই বারবার জীবন দিয়েছে। কিন্তু নির্মাতা অগ্নিহোত্রী সেটা মানতে নারাজ। তার মতে, ‘ভারতের ভাগ্য দিল্লিতে লেখা, বাংলায় নয়।’ তিনি বলেছেন, বাংলার ঘটনাগুলো ১৯৪০-এর দশকে দিল্লিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। আর সেভাবেই তিনি সিনেমাটির প্লট সাজিয়েছেন বলে তৃণমূলের অভিযোগ। সিনেমাটির বিরোধিতাকারী ও তৃণমূলের মতে, এটি পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পেলে সেই পুরোনো হিন্দু মুসলিম বিরোধ নতুন করে শুরু হতে পারে। যেটা বিজেপির দীর্ঘদিনের অভিপ্রায়।
মূলত সিনেমার নাম পালটে দেওয়ার পরপরই বাংলার মানুষ টের পেয়েছে, দিল্লির প্রেক্ষাপট নিয়ে এটি তৈরি হলেও তাতে বাংলার রাজনীতি দেখানো হবে। তাই টিজার মুক্তি পেতেই শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। টিজারে দেখানো হয়েছে একটি দুর্গা প্রতিমা জ্বলে যাওয়ার দৃশ্য, যাকে ঘিরেই মূলত তৈরি হয়েছে বিতর্ক। অনেকের মতে, সিনেমাটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে মানুষের মনে। রাজ্যের রাজনীতি বদলে দেওয়ার গোপন ষড়যন্ত্রও দেখছেন কেউ কেউ। আর সেই বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলেছে ট্রেলার।
সিনেমা সংশ্লিষ্টদের বয়ান
কলকাতার ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষেপেছেন এ সিনেমার অভিনেত্রী পল্লবী জোশি। তিনি বিজেপির একজন কট্টর সমর্থকও বটে। অভিনেত্রী ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠান ঘিরে যা হয়েছে তা দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে না, বেঙ্গল ফাইলস সিনেমা তৈরি হওয়া দরকার ছিল। দেখুন কী হচ্ছে বাংলায়। সেই কারণে এ ধরনের সিনেমা এখনকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমি প্রত্যেক ভারতবাসীকে এই সিনেমার দেখার জন্য অনুরোধ করব। যাতে তারা বাংলার আসল রূপ দেখতে পারে। একটা সিনেমাকে কেন এত ভয় পাচ্ছে সরকার?’
পশ্চিমবঙ্গে সিনেমাটি মুক্তির অনুমতি মেলেনি এখনো। হোটেলে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোজক অভিষেক আগরওয়াল অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে অনুমতি না পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তাহলে কেন যখন টেস্টিং চলছিল, তখন নিষেধ করা হয়নি? পাঁচতারা একটি হোটেলে অনুমতি ছাড়া কী কোনো কাজ চলতে পারে? থিয়েটারে অনুমতি বাতিল করার পর আমরা হোটেলে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু সেখানেও বাধা দেওয়া হয়েছে।’
কী বলছে তৃণমূল ও বিজেপি
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন চুপ থাকেনি রাজ্যের শাসকদল মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র তন্ময় ঘোষ ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বেঙ্গল ফাইলসে সম্পূর্ণভাবে ইতিহাস বিকৃত করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে বাংলার মানুষ এ সিনেমাকে এখানে চলতে দেবে না। আগামী দিনে আরও বিক্ষোভ হবে। ওনাদের মাথায় থাকা উচিত কোন মাটিতে দাঁড়িয়ে এ সিনেমা বানিয়েছেন। এটা বাংলার মাটি, প্রগতিশীলতার মাটি, এটা বিপ্লবের মাটি, স্বাধীনতা আন্দোলনের মাটি। এটা বাঙালি অস্তিত্বকে ধাক্কা দিচ্ছে। বাংলার সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে। সম্প্রতির সংস্কৃতিকে উসকে দিচ্ছে। বাংলায় যেখানে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা চলে, মৃণাল সেনের সিনেমা সেখানে এ ধরনের প্রোপাগান্ড সিনেমা বাংলার মানুষ মেনে নেবে না।’
অন্যদিকে বিজেপি নেতা জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্যতম স্তম্ভ। পশ্চিমবঙ্গে একটা সিনেমা কেন করা যাবে না? কেন একটা ট্রেলার দেখানো যাবে না? সত্যকে কি এভাবে চাপা দিয়ে রাখা যায়? আজ সেই ১৬ আগস্ট, (হোটেলে ট্রেলার লঞ্চ বন্ধ করার দিন) ১৯৪৬ সালে যেদিন সুরাবর্দি ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দিয়েছিল। ৪০ হাজার হিন্দু বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সত্যের ওপর তৈরি করা সেই সিনেমা যদি আজকে দেখানো হয়, তাহলে তাতে ভয় পাচ্ছে কেন এই রাজ্যের শাসকদল? বোঝাই যাচ্ছে এই ভয় তাদের পরাজয়ের ভয়।’
নতুন করে দাঙ্গা উসকে দিচ্ছেন কেউ কেউ
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করে রাজ্যে শান্তি বজায় রাখার জন্য যখন অনেক নির্মাতা ও তারকা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন এই বিতর্ক আরও উসকে দিচ্ছেন আরেক সিনেমা নির্মাতা শুভজিৎ মিত্র। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট দিয়েছেন, যেখানে সেই পুরনো দাঙ্গার জন্য মুসলিমদের দায়ী করেছেন। ওই সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘এক যুবক মুসলমান ছেলে দাদুকে (শুভজিদের দাদু) মাংস কাটার ছুরি দিয়ে কোপ মারে। দাদুর হাতে ছোট পিসির জন্য কেনা দুধের বড় কৌটো ছিল। সেটা দিয়ে আঘাত প্রতিহত করলে কোপটা হাতে পড়ে। গলা, বুক বেঁচে যায়। ছেলেটি পালায়।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আগের দিন (দাঙ্গা সংগঠিত হওয়ার শুরুর আগে) মনুমেন্টের সামনে মুসলিম লীগ-এর বিশাল জমায়েতে সুরাবর্দি মুসলিমদের উস্কানি দেয়। সুরাবর্দির ডান হাত ছিল শেখ মুজিবর রহমান। যার কাজ ছিল বিহার থেকে মুসলমান এনে কলকাতায় দাঙ্গা করা। যাতে কলকাতাকে কোনোভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ঢোকানো যায়।’ এসব ইতিহাস তিনি তার দাদুর কাছ থেকে জেনেছেন বলেও পোস্টে উল্লেখ করেছেন।
সিনেমায় যারা অভিনয় করেছেন
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন দর্শন কুমার, পল্লবী জোশী, সিমরত কৌর, মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের (মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে), শাশ্বত চ্যাটার্জি, নমাশী চক্রবর্তী, রাজেশ খেরা (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চরিত্রে), পুনীত ইসার, প্রিয়াংশু চ্যাটার্জি, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, সৌরভ দাস, মোহন কাপুর, একলব্য সুদ, অনুভা অরোরাসহ