সাংবাদিকতা আজ কোন পথে?
অবশ্যই, নিচে তথ্য-উপাত্ত সংযোজন করে এবং কিছু জাতীয় পর্যায়ের প্রাস
সাংবাদিকতা আজ কোন পথে?
মাহবুবুর রহমান চান্দু
শফিকুল ইসলাম কাজল
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা একসময় গণমানুষের কণ্ঠস্বর ছিল, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে উচ্চারিত হতো যেকোনো গণমাধ্যমের প্রতিবেদন। কিন্তু বর্তমানে সেই পথ যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। পেশার আদর্শ ও নৈতিকতা এখন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে কিছু অপসাংবাদিকতার কারণে। সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি, অশ্লীলতা, অযোগ্যতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সুস্থধারার গণমাধ্যম চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কিছু গণমাধ্যম এই অপসংস্কৃতির পেছনে বড় দায়ী হলেও, ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু তথাকথিত ‘সাংবাদিক’ বা ‘অ-সাংবাদিক’ প্রতারণামূলক কৌশলের মাধ্যমে সাংবাদিকতার নাম ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে নিচ্ছে।
আমাদের মেহেরপুর জেলাতেও এই চিত্র এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। কিছু ব্যক্তি মিথ্যা পরিচয়ে সাংবাদিকতা পেশার নাম ভাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফেলছে। মিথ্যা সংবাদ তৈরির ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চরিত্রহননের মতো কাজ—এসব এখন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
বাস্তব চিত্র ও পরিসংখ্যান
- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) ২০২৩ সালের এক গবেষণায় উল্লেখ করে, গণমাধ্যমে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অন্যতম কারণ হিসেবে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক সংকট ও অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির অভাবকে দায়ী করা হয়েছে।
- বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ২০২2 সালে জানায়, দেশে নিবন্ধিত সাংবাদিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ “অনিবন্ধিত” বা “ভুয়া” সাংবাদিক রয়েছে, যারা স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয়ে নানা অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত।
- ২০২৩ সালে সারা দেশে সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৯৩টি, যার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তথাকথিত সাংবাদিকরা মিথ্যা সংবাদ বা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছেন।
- ২০২4 সালের এক ডিজিটাল গণমাধ্যম জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ অনলাইন সংবাদমাধ্যমের মালিকানা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক সংযোগসম্পন্ন, যার কারণে সংবাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
কীভাবে উত্তরণ?
এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো – সুস্থচিন্তার সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় ভূমিকা। অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, নিজেদের ভেতরের ছাঁকনি ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে।
প্রস্তাবিত কিছু পদক্ষেপ:সা ১ বাদিকতার পেশাগত সনদ বাধ্যতামূলক করতে হবে। যেমন: আইনজীবীদের বার কাউন্সিল, চিকিৎসকদের বিএমডিসি, তেমনি সাংবাদিকদের একটি পেশাগত সনদ ও যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত ২ জেলা পর্যায়ে সাংবাদিক নিবন্ধন ও যাচাই কমিটি গঠন করে নিয়মিত তালিকা হালনাগাদ করতে হবে৩ প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতা বাড়ানো এবং স্থানীয় পর্যায়ে এর কার্যকর শাখা বিস্তৃত করা ৪ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে স্থানীয় গণমাধ্যম, সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ও ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা৫সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, যাতে তারা দুর্নীতির ফাঁদে না পড়েন।
সাধারণ মানুষের ভূমিকা
শুধু সাংবাদিকদের পেশাগত সততা নয়, সাধারণ মানুষকেও ভুয়া সাংবাদিক বা চাঁদাবাজদের চিনে নিতে হবে। একজন প্রকৃত সাংবাদিক তথ্য যাচাই করে সংবাদ পরিবেশন করেন, ভয় দেখিয়ে নয়। কাজেই কোথাও সাংবাদিকতার অপব্যবহার দেখা গেলে স্থানীয় প্রশাসন বা প্রেস ক্লাবে তা জানানোর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে
সাংবাদিকতা জাতির চতুর্থ স্তম্ভ। এর ভিত দুর্বল হলে গণতন্ত্রও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। কিছু অসাধু ব্যক্তির অপকর্মের দায় সমগ্র পেশা বহন করতে পারে না। তাই সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর।
আসুন, অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, স্খলিতদের মন থেকে ঘৃণা করি, এবং সত্য, দক্ষতা ও নৈতিকতার পথেই সাংবাদিকতাকে ফিরিয়ে আনি।
লেখক:
শফিকুল ইসলাম কাজল
মাহবুবুর রহমান চান্দু
(সাংবাদিক, মেহেরপুর)