বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই ২০১৯
প্রথম পাতা » রাজনীতি | সম্পাদক বলছি » শহীদ কমরেড তাহের বীর উত্তমের ফাসির পুর্বে শেষ চিঠি
শহীদ কমরেড তাহের বীর উত্তমের ফাসির পুর্বে শেষ চিঠি
১৮ জুলাই, ১৯৭৬ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে শহীদ কমরেড কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের শেষ চিঠি
শ্রদ্ধেয় আব্বা, আম্মা, প্রিয় লুৎফা, ভাইজান, আমার ভাই ও বোনেরা,
গতকাল বিকাল বেলা ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়া হলো। আমার জন্য মৃত্যুদন্ড। ভাইজান (তাহেরের বড়ভাই আবু ইউসুফ খান) ও মেজর জলিলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড-সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। আনোয়ার, ইনু, রব ও মেজর জিয়ার ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা। সালেহা, রবিউলের ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড। ড. আখলাক, সাংবাদিক মাহমুদ ও মান্না সহ ১৩ জনকে মুক্তিদান। সর্বশেষে ট্রাইব্যুনাল আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মতো তাড়াহুড়া করে বিচার কক্ষ পরিত্যাগ করল।
হঠাৎ মাহমুদ সাহেব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমি তাঁকে সান্তনা দিতে তিনি বললেন, ‘আমার কান্না এ জন্য যে একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষণা করতে পারল।’ বোন সালেহা হঠাৎ টয়লেট রুমে যেয়ে কাঁদতে শুরু করল। সালেহাকে ডেকে এনে যখন বললাম, ‘তোমার কাছ থেকে এ দুর্বলতা কখনই আশা করি না।’ সালেহা বলল, ‘আমি কাঁদি নাই, আমি হাসছি।’ হাসি-কান্নায় এই বোনটি আমার অপূর্ব। জেলখানার এই বিচার কক্ষে এসে প্রথম তার সঙ্গে আমার দেখা। এই বোনটিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কোনি জাতি এর মতো বোন সৃষ্টি করতে পারে।
সশস্র বাহিনীর অভিযুক্তদের শুধু একটি কথা, ‘কেন তাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো না’। মেজর জিয়া বসে আমার উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখল। জেলখানার এই ক্ষুদ্র কক্ষে হঠাৎ আওয়াজ উঠল, ‘তাহের ভাই, লাল সালাম’। সমস্ত জেলখানা প্রকম্পিত হয়ে উঠল। জেলখানার উঁচু দেয়াল এই প্রতিধ্বনি কি আটকে রাখতে পারবে? এর প্রতিধ্বনি কি পৌঁছবে না আমার দেশের মানুষের মনের কোঠায়?
রায় শুনে আমাদের আইনজীবীরা হঠাৎ হতবাক হয়ে গেলেন। তারা এসে আমাকে বললেন, যদিও এই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না, তারা সুপ্রিম কোর্টে রিট করবেন। কারণ, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এই আদালত তার কাজ চালিয়েছে ও রায় দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করবেন বলে বললেন। আমি তাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলাম, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো আবেদন করা চলবে না। এই রাষ্ট্রপতিকে আমিই রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছি। এই দেশদ্রোহীদের কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না।’
সবাই আমার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শুনতে চাইল। এর মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। আমি বললাম, আমি যখন একা থাকি তখন ভয়, লোভ, লালসা আমাকে চারদিক থেকে এসে আক্রমণ করে। আমি যখন আপানাদের মাঝে থাকি, তখন সমস্ত ভয়, লোভ, লালসা দূরে চলে যায়। আমি সাহসী হই, আমি বিপ্লবের সাহসীরূপে নিজেকে দেখতে পাই। সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করার এক অপরাজেয় শক্তি আমার মধ্যে প্রবেশ করে। তাই আমাদের একাকিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সবার মাঝে প্রকাশিত হতে চাই। সে জন্যই আমাদের সংগ্রাম।
সবাই একে একে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। অশ্রুসজল চোখ। বেশ কিছু দিন সবাই একত্রে কাটিয়েছি। আবার কবে দেখা হবে। সালেহা আমার সঙ্গে যাবে। ভাইজান, আনোয়ারকে চিত্তচাঞ্চল্য স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু তাদের তো আমি জানি। আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য তাদের অভিনয়। বেলালের চোখ ছলছল করছে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায়। (বেলাল-তাহেরের ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন রহমান বেলাল) জলিল, রব, জিয়া আমাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। এই আলিঙ্গন অবিচ্ছেদ্য। এমনিভাবে দৃঢ় আলিঙ্গনে আমরা সমগ্র জাতির সঙ্গে আবদ্ধ। কেউ তা ভাঙ্গতে পারবে না। সবাই চলে গেল। আমি আর সালেহা বের হয়ে এলাম, সালেহা চলে গেল তার সেলে। বিভিন্ন সেলে আবদ্ধ কয়েদি ও রাজবন্দিরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বন্ধ সেলের দরজা-জানালা দিয়ে। মতিন সাহেব, টিপু বিশ্বাস ও অন্যরা দেখাল আমাকে বিজয় চিহ্ন। এই বিচার বিপ্লবীদের তাদের অগোচরে এক করল।
ফাঁসির আসামীদের নির্ধারিত জায়গা ৮ সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলো। পাশের তিনটি সেলে আরও তিনজন ফাঁসির আসামি, ছোট্ট সেলটি ভালই বেশ পরিষ্কার। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই, তাতে লজ্জার তো কিছুই নেই। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর মতো বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে।
ফাঁসির আসামীদের নির্ধারিত জায়গা ৮ সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলো। পাশের তিনটি সেলে আরও তিনজন ফাঁসির আসামি, ছোট্ট সেলটি ভালই বেশ পরিষ্কার। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই, তাতে লজ্জার তো কিছুই নেই। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর মতো বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে।
নিতু, যিশু ও মিশুর কথা। সবার কথা মনে পড়ে। তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ কিছুই আমি রেখে যাইনি। কিন্তু আমার সমগ্র জাতি রয়েছে তাদের জন্য। আমরা দেখেছি, শত সহ¯স্র উলঙ্গ, মায়া, ভালোবাসা বঞ্চিত শিশু। তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি। বাঙালি জাতির জন্য উদ্ভাসিত সূর্যের আর কত দেরি। না, আর দেরি নেই। সূর্য উঠল বলে। এ দেশ সৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব, যা আমার জাতিকে আলোকিত করবে, উজ্জীবিত করবেÑএর চাইতে বড় পুরস্কার আমার জন্য আর কী হতে পারে।
আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে। কোন শক্তি তা করতে পারে। কেউ পারবে না।
আজকের পত্রিকা এলো। আমার মৃত্যুদ- ও অন্যদের বিভিন্ন শাস্তির খবর ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। মামলার যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। রাজসাক্ষীদের জবানবন্দিতে প্রকাশ পেয়েছে আমার নেতৃত্বে ৭ই নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব ঘটে, আমার নির্দেশে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। আমার দ্বারা বর্তমান সরকার গঠন করা হয়। সমগ্র মামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর কোনো উল্লেখই ছিল না। এডভোকেট আতাউর রহমান, জুলমত আলী ও অন্যরা যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা যেন এই মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করেন ও সমগ্র মামলাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। আমি মৃত্যুর জন্য ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও চক্রান্তকারী জিয়া আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আতাউর রহমান ও অন্যদের বলবে, সত্য প্রকাশ তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে তারা যদি ব্যর্থ হন, তবে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
তোমরা আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আদর নিও। বিচার কক্ষে বসে জিয়া অনেক কবিতা লেখে, তারই একটি অংশ:
‘জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম।
জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙ্গব বলে ভেঙ্গে দিলাম।
জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর রেখে গেলাম।
পাথরের নিচে, শোষক আর শাসকের কবর দিলাম।
পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।’
তোমাদের,
তাহের,
ঢাকা সেন্ট্রাল জেল,
১৮ই জুলাই ’৭৬ সাল।