
শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » রাজনীতি » বাংলাদেশ: ২০২৬ সালের বিরোধী শূন্য নির্বাচনের সব প্রস্তুতি
বাংলাদেশ: ২০২৬ সালের বিরোধী শূন্য নির্বাচনের সব প্রস্তুতি
নর্থ নিউজ থেকে নেওয়া-বিধান চন্দ্র দাসঃ
বাংলাদেশ: ২০২৬ সালের বিরোধী শূন্য নির্বাচনের সব প্রস্তুতি
যদি সবকিছু সুসম্পন্ন হয় ড. মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক, তাহলে বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনে একটা নকল ফলাফলই নিশ্চিত হবে, যা সম্ভবত অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি-রমজানৃ অধঃপতনের ঠিক আগেই।
ইতিহাস সম্মতভাবে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল) ও জাতীয় পার্টি-এই দুই দল মিলে দেশজুড়ে পরিমাপ করলে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ভোটারের অর্ধেকের সমর্থন পায়। এই দুই দল যদি নির্বাচনে না অংশগ্রহণ করে, তাহলে বিএনপি-এর জন্য মাঠ একচেটিয়া হয়ে যাবে এবং তারা নির্দ্বিধায় জয় হাসিল করতে পারবে। তবে এই বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হবে, তাই না, সন্দেহ থাকে।
ইসলামপন্থী জোট জামায়াত-ই-ইসলামি-যার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে-আবার নীল নকশা অনুযায়ী উঠে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরেক দল, নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি), যা জামায়াতের একটা ছাতাপত্র বলে দেখা হয়, তারা তৃতীয় অবস্থানে যেতে পারে।
ইসলামপন্থীদের সুবিধা জামায়াত ও এনসিপি উভয়েরই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ড. ইউনুস প্রকাশ্যে এনসিপি নেতাদের সমর্থন দিয়ে তাদের নীতিনির্ধারণে অকার্যকর ভূমিকা দিয়েছেন। অন্যদিকে জামায়াত নিচুতল থেকে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করছে। অতীতে জামায়াত কখনোই জাতীয় ভোটের ৫%-এর বেশি পায়নি, কিন্তু আওয়ামী লীগ বাদ পড়লে তাদের ভোটহার ২০% ছাড়িয়ে যেতে পারে। দুই দল আলাদাভাবে নির্বাচনে লড়াই করার ধারাবাহিকতা দেখাবে, যদিও তারা যৌথভাবে একটা ইসলামী প্রজাতন্ত্র গড়তে কাজ করছে। ভোট পরবর্তী গঠনশিল পর্বে তারা বিএনপি সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলে নিতে পারে-এর প্রমাণ ইতিমধ্যেই লক্ষণীয়।
মার্চে ঢাকার একটা আদালত ২০২০ সালের পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই রায় কার্যকর করেনি। বিপরীতে, তারা দ্রুত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান হিসেবে এক কঠোরপন্থী ইসলামপন্থী (যিনি নিষিদ্ধ হিযব উৎ-তাহরির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ) মনোনীত করেছে।
গণতান্ত্রিক স্থান সংকুচিতকরণ পুনর্বিবেচনা করলে দেখা যায়, ড. ইউনুস সম্ভবত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ক্ষতিই বাড়াচ্ছেন-মজলিছ-শাসকদের চেয়েও। মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগ, যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় দল, পারলে ৪০% ভোট তো পেতেই-অন্তত নিম্নমাপে ২৫% শেয়ারও বজায় রাখে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার ছিল ইসলামপন্থী উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রথম সারিতে। তাকে ক্ষমতায় আনার পর বাংলাদেশকে এফএটিএফের ধূসর তালিকা থেকে বের করে এনে বিনিয়োগ-বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টির কাজ করেন তিনি। Ironically, যেই দল সেই স্থিতিশীলতার নভেলায় ছিল, তাকেই “রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে” অভিযুক্ত করে নিষিদ্ধ করল ইউনুস প্রশাসন।
জাতীয় পার্টি-যার ভোটভাগ সাধারণত ৮-৯%-সরকারিভাবে নিষিদ্ধ না হয়েও প্রায় ১০ মাস যাবত সকল রাজনৈতিক আলোচনায় বাদ পড়েছে। তাদের দফতরে হামলা চালানো হচ্ছে, এমনকি সভাপতি জি.এম. কাদেরের বাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ইতিমধ্যে মত প্রকাশ দমন গত ১০ মাসে ইউনুস প্রশাসন কয়েকশ’ অপরাধী ও পরিচিত উগ্রবাদের নেতাকে ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার আওয়ামী লীগকর্মী, সাংবাদিক, সিভিল সোসাইটি নেতৃবৃন্দ ও আইনজীবীকে গ্রেফতার করেছে-অনেকের বিরুদ্ধে রায় অনিবার্যভাবেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হচ্ছে।
এপ্রিল মাসে বরিষ্ঠ আইনজীবী তুরীন আফরোজ (যিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রাক্তন প্রসিকিউর) ২০২৪ সালের জুলাই বিক্ষোভ-সংক্রান্ত ঘটনায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হন। বর্তমানে ২৬৬ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিরাপত্তাহীনতার ভিতর, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাণনাশের মামলা রয়েছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-দেশের স্থপতি ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নায়কের-উল্লেখ নিয়েও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে। ২০২৩ সালের “মুজিব: দ্য মেকিং অফ এ নেশন” চলচ্চিত্রে অভিনয়কারী এক অভিনেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরকে ২০১৮ সালের একটি ঘটনায় দুর্নীতির নোটিশ দেয়া হয়েছে-যে প্রফেসর আসলে সেই ঘটনায়ও Whistleblower ছিলেন।
উপসংহার: এক জাতি সংকটমোড়ে লক্ষ্য স্পষ্ট-অন্তর্বর্তী প্রশাসন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলে ইসলামপন্থীর আধিপত্যের পথ প্রশস্ত করছে। মতপ্রকাশ দমন, ইতিহাস মোছা, রাজনৈতিক বিকল্প নির্মূল-এগুলো হচ্ছে তাদের মূল অস্ত্র। ২০২৬ সালের নির্বাচন ঘিরে বাস্তব লড়াই আর কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যেই থাকবে না; এটা হবে নকল ধর্মতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে-একুশে এপ্রিলের রক্তমাখা মাটিতে স্থাপিত গণতান্ত্রিক আদর্শের-সংগ্রাম।