
বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ | ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » আফসানার মৃত্যুতে দেশজুড়ে তোলপাড়
আফসানার মৃত্যুতে দেশজুড়ে তোলপাড়
মিরপুরের সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির শিার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নকর্মী আফসানা ফেরদৌসের রহস্যজনক মৃত্যুতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে দেশজুড়ে। আফসানার মৃত্যুকে ধর্ষণের পর হত্যাকা- দাবি করে গতকাল রাজধানীর শাহবাগ ও আফসানার বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন স্কুল-কলেজের শিার্থী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ। আফসানার খুনিদের গ্রেপ্তার ও তেজগাঁও কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীদের ওপর গতকাল হামলার প্রতিবাদে ১৯ আগস্ট দেশব্যাপী বিােভের ডাক দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন।
স্থাপত্যবিদ্যার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আফসানার মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় চলছে ফেসবুকেও। তার পরিচিতজন ছাড়াও অসংখ্য ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন। আফসানা ফেরদৌসের মৃত্যুকে নিষ্ঠুর হত্যাকা- আখ্যা দিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাও। সংস্থাটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা অবিলম্বে আফসানা হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
অভিযোগ উঠেছে, আফসানার মৃত্যুর ঘটনায় সোচ্চার হওয়ার কারণে ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীকে রড ও লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করেছে তেজগাঁও কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী। গতকাল বুধবার বিকাল সোয়া ৩টার দিকে কলেজ ক্যাম্পাসের সামনে এই হামলার ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন তেজগাঁও কলেজ সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অন্তুচন্দ্র নাথ, প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন রাজু, এজিএস কামরুল হাসান ও শিক্ষার্থী সাইদ। তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের মধ্যে অন্তুচন্দ্র নাথের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। হামলাকারীরা আফসানার মৃত্যুর ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনের অনুসারী বলে জানিয়েছেন আহতরা।
এদিকে আফসানার লাশ উদ্ধারের পর ৪ দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। পুলিশ আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি অভিযুক্ত একজনকেও। অভিযুক্তরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছেÑ এমন অভিযোগ করছেন আফসানার পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও অনেকে।
তবে পুলিশ বলছে, আন্তরিকতার সঙ্গেই তদন্ত চালানো হচ্ছে। অগ্রগতিও হয়েছে। গত সোমবার মিরপুরের আল হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে আফসানাকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া দুই যুবককে হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। ওই যুবকদের পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।
আফসানার লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ শফিউজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, আফসানার শরীরের বিভিন্ন অংশ ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ভিসেরা পরীার জন্য মহাখালীর রাসায়নিক পরীাগারে পাঠানো হয়েছে। ভিসেরা প্রতিবেদন হাতে পেলে জানা যাবে আফসানা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন কিনা। তা ছাড়া মৃত্যুর আগে তিনি পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কিনা কিংবা শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে কিনা।
প্রসঙ্গত, ১৩ আগস্ট সাইকের শিক্ষার্থী আফসানার লাশ মিরপুরের আল হেলাল হাসপাতাল থেকে বেওয়ারিশ হিসেবে উদ্ধার করে পুলিশ।
গতকাল আফসানার আত্মীয় জার্মানি দূতাবাসের প্রাক্তন রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও স্বভূমি লেখক শিল্পী কেন্দ্রের সভাপতি কবি মুজতবা আহমেদ মুরশেদ জানান, সার্বিক পরিস্থিতি বলছে এটি হত্যাকা-। আফসানাকে ধর্ষণের পর রশির মতো কোনো কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। আর এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিন ও তার সহযোগী সৌরভ, বাবু ছাড়াও আরও কয়েকজন। ওই ছাত্রলীগ নেতার পরিবার ও তার সহযোগীরা এ বিষয়ে মামলা না করতে এবং বাড়াবাড়ি না করতে আফসানার পরিবারকে ভিন্ন ভিন্ন নম্বর থেকে মোবাইল ফোনে হুমকি দিচ্ছে। হত্যাকারীরা রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে পার পেতে চাইছে বলে অভিযোগ করেন মুরশেদ।
আফসানার মামা মিন্টু জানান, আমার ভাগ্নির গলায় একটা দাগ ছাড়া আর কোনো দাগ দেখা যায়নি। তাই ধারণা করছি, রশি জাতীয় কিছু দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরই আমরা হত্যা মামলা করব।
এ ঘটনায় এখনো কাউকে আটক করা হয়নি জানিয়ে আফসানার অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানার এসআই ফজলু আমাদের সময়কে বলেন, হত্যাকা- না আত্মহত্যা তা জানতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপো করতে হবে। আল হেলাল হাসপাতালসহ ওই এলাকার বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজের সূত্র ধরে অভিযুক্তদের শনাক্ত করা যাবে বলে ধারণা করছি।
আফসানা ফেরদৌসের হত্যার বিচারের দাবিতে গতকাল দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া এলাকার চৌরাস্তা মোড়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় আফসানার পরিবার ছাড়াও ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার পারভেজ পুলকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও স্কুল-কলেজের শিার্থী এবং সর্বস্তরের মানুষ এই মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। ঠাকুরগাঁও রুহিয়া এলাকাবাসীর আয়োজনে এই মানববন্ধনে রুহিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক তরিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন রুহিয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্য মামুনুর রশিদ, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জব্বার, সাবেক ভিপি বদরুল ইসলাম, প্রভাষক গোলাম মোস্তফা, ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল হক বাবু, সাবেক ছাত্রনেতা আবু সাইদ বাবু, বিএনপি নেতা আবদুুল মালেক মানিক, আবদুল হক, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দুলাল রব্বানী প্রমুখ। আফসানাকে তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনসহ কয়েক বন্ধু অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন বক্তারা। রবিনকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।
এদিকে ছাত্র ইউনিয়নকর্মী আফসানা ফেরদৌসের হত্যাকা- ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গতকাল রাজধানীর শাহবাগে ছাত্র ইউনিয়নের এক বিােভ সমাবেশে তিনি বলেন, হত্যার চারদিন পরেও পুলিশ রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। বরং আফসানার হত্যাকা- ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি লাকী আক্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিােভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি লিটন নন্দী, ঢাকা মহানগর সভাপতি অনিক রায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আল আমিন, কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক সিয়াম সারোয়ার জামিল প্রমুখ।
ডাকসুর সাবেক ভিপি সেলিম বলেন, আফসানা হত্যাকা- বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা দেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রোপটেরই একটা অংশ। এর আগে তনু, মিতুসহ আরও অনেকেই খুনের শিকার হয়েছেন। কোনোটিরই সুরাহা হয়নি। পুলিশ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার আগেই আফসানার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা করছে। এর মধ্য দিয়ে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, পুলিশ খুনিদের রা করতে চাইছে।
ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি লাকী আক্তার বলেন, তনু-মিতুর পর আফসানা হত্যাকা- ঘটলেও পুলিশ নীরব। হত্যার ৪ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত সরকারের দায়িত্ববান কারো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যাদের হত্যার সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তারাই আজ (বুধবার) বিকালে ছাত্র ইউনিয়নের তেজগাঁও কলেজের সভাপতি শামীম আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক অন্তুচন্দ্র নাথসহ সংগঠনের ৫ নেতাকর্মীকে রড-হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়েছে। হামলায় তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নেতৃত্ব দিয়েছে। এ হামলা প্রমাণ করে খুনের সঙ্গে কারা জড়িত।
সমাবেশ থেকে আফসানা ফেরদৌসের খুনিদের গ্রেপ্তার ও তেজগাঁও কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ১৯ আগস্ট দেশব্যাপী বিােভ ও ২২ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। এ ছাড়া আজ দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।