
শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » ব্রেকিং নিউজ | রাজনীতি » ক্ষমতার নতুন ব্যাকরণ শুদ্ধি অভিযান, প্রতিশোধ না কৌশলী পুনর্গঠন?
ক্ষমতার নতুন ব্যাকরণ শুদ্ধি অভিযান, প্রতিশোধ না কৌশলী পুনর্গঠন?
লন্ডন থেকে কাজলঃ বাংলাদেশে ২০২৫ সালের জুনের দ্বিতীয়ার্ধ যেন এক রাজনৈতিক ভূমিকম্পের আলামত বহন করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে সূক্ষ্ম পুনর্বিন্যাস, ঢাকায় রাতভর অভিযান চালিয়ে আটজন প্রভাবশালী ব্যক্তি গ্রেপ্তার, এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদের রদবদল-সব মিলিয়ে স্পষ্টতই একটি বড় কৌশলী খেলা চলছে। প্রশ্ন উঠছে: এটি কি দলীয় শুদ্ধি অভিযান, নাকি রাজনৈতিক প্রতিশোধ? নাকি এর আড়ালে চলছে আরও গভীর কোনো পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া?
গ্রেপ্তার অভিযানের ইঙ্গিত
ডিবি ও থানা পুলিশের সমন্বিত অভিযানে গ্রেপ্তার হন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, সাবেক এমপি মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব, সাবেক নারী এমপি, ইসলামী ব্যাংকের প্রাক্তন এমডি এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। যাদের একাংশ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ স্তরে অবস্থান করছিলেন, হঠাৎ করে তাঁদের এই গ্রেপ্তার এক রহস্যঘন বার্তা বহন করছে।
প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভাঙনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে যারা অভ্যস্ত পর্যালোচক, তারা জানেন-এই ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি কতটা বহুমাত্রিক, আর তার বাস্তব প্রয়োগ কতটা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত।
পুলিশ রদবদল: শুধু আদেশ নয়, রাজনীতির ভাষা
ঠিক এই গ্রেপ্তারের আগেই বা পরেই-প্রায় সমান্তরালে-বাংলাদেশ পুলিশের শীর্ষস্তরে একাধিক পদে রদবদল ঘটে। যে রেজাউল করিম মল্লিক ডিবি প্রধান হিসেবে এই আলোচিত গ্রেপ্তারে নেতৃত্ব দেন, তাকেই সরিয়ে দেওয়া হয় রেঞ্জ পদে। একই সময়ে সিআইডির মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় মো. শিবগাত উল্লাহকে-যিনি আগেও প্রশংসিত হলেও ক্ষমতাবান বলয়ের বাইরের বলে পরিচিত ছিলেন।
এসব রদবদল প্রশাসনিক শুদ্ধি অভিযানের অংশ হলে-তবে কি পুরনো রাজনৈতিক আনুগত্যের অফিসারদের সরিয়ে নতুন বলয়ের আস্থাভাজনদের বসানো হচ্ছে? নাকি মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ কৌশলগতভাবে পাল্টানো হচ্ছে, যাতে তদন্ত ও নজরদারির বৃত্ত নিয়ন্ত্রিত থাকে?
অর্থনৈতিক রাজনীতির ছায়া
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি মনিরুল মওলার গ্রেপ্তার একটি বড় অর্থনৈতিক ইঙ্গিতও দেয়। কমিশনভিত্তিক লোন অনুমোদন, প্রভাবশালী মহলের অর্থ পাচার-এসব নিয়ে বারবার যে বিতর্ক এসেছে, তার অবশেষে কি প্রতীকী জবাবদিহিতার সুযোগ তৈরি হয়েছে? নাকি এটি পুরনো বলয়ের ভিতরকার আর্থিক শক্তিকে ভেঙে নতুন বলয়কে বিনা প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠিত করার পথ?
আন্তর্জাতিক বার্তা ও ইমেজ ম্যানেজমেন্ট
এখনকার বিশ্ব রাজনীতিতে ‘law and order’ বা দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান যতটা বাস্তব প্রয়োজন, তার চেয়েও বেশি কূটনৈতিক ভাষা। তাই এই ধরনের অভিযান ও রদবদল আন্তর্জাতিক মহলে একটি বার্তা পৌঁছে দেয়: “বাংলাদেশ সরকার শক্তিশালী, নিয়ন্ত্রণে আছে, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন।”
তবে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় প্রশ্ন থাকে-এই শক্তি প্রদর্শন আদতে কার বিরুদ্ধে, এবং কার অনুকূলে?
মিডিয়া কাভারেজ ও জনবক্তৃতা নিয়ন্ত্রণ
সরকারপন্থী ও বিরোধীপন্থী মিডিয়ার বয়ান যেভাবে ভিন্ন, তাতে স্পষ্ট-এটি কেবল আইন প্রয়োগের ঘটনা নয়, এটি একটি বয়ান যুদ্ধ। যেখানে একপক্ষ বলছে “ষড়যন্ত্রকারী চক্রের বিরুদ্ধে সফল অভিযান”, অন্যপক্ষ বলছে “দলীয় বলয়ের মধ্যে প্রতিশোধমূলক সাফাইকরণ”।
সবকিছুকে মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এক ‘সফট রিসেট’ চলছে-যেখানে শুদ্ধি, প্রতিশোধ, নিয়ন্ত্রণ ও ইমেজ-সবকিছু একসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি নিছক প্রশাসনিক ‘রদবদল’ নয়; এটি ক্ষমতার একটি নতুন রচনার সূচনা, যার ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে দলীয় রাজনীতি, রাষ্ট্রের কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হবে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে, আর কে শুধু পর্যবেক্ষক হয়ে থাকবে-তা নির্ধারিত হচ্ছে কৌশল, দখল ও বিশ্বাসের এক গভীর পটভূমিতে। সেই কাহিনির মোড়টাই এখন নতুন করে লেখা হচ্ছে-আলো কিংবা অন্ধকারের ডামাডোলের মাঝখানে।